তীব্র ডলার সংকট দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের
নিজস্ব প্রতিবেদক
আরটিএনএন
ঢাকা: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসা এবং ডলার সংকটের কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। আন্তর্জাতিক সংস্থা মুডিস ইনভেস্টর এবং এসএন্ডপি গ্লোবাল বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেয়ায় নতুন করে ঋণ কতোটা পাওয়া যাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সাধারণত এ ধরনের সংস্থার ঋণমান কমিয়ে দেয়ার কারণে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি হারে সুদ দিতে হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ গত অর্থবছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ পেলেও চলতি বছর এখন পর্যন্ত এ ধরনের ঋণ আসেনি। আবার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সংকটে বৈদেশিক ঋণের সুদ বাড়ছে এবং পাশাপাশি কমছে ঋণ পরিশোধের সময়। ফলে গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়ে গেছে ঋণ পরিশোধের চাপও।
এদিকে ডলার সংকট নিয়ে উদ্বেগ কাটেনি ব্যবসায়ীদের। ডলার সংকটে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে এখনো সমস্যায় পড়ছেন উদ্যোক্তারা। ডলার সংকট ও দর বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। সবমিলিয়ে এই পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপদে ফেলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি ঋণে বেশকিছু প্রকল্প আছে যাতে অতিরিক্ত খরচ করা হয়েছে। তার মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশকে।
জানা গেছে, গত মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। মাসের শুরুতে যে ডলার কার্ব মার্কেটে ১১৩ থেকে ১১৪ টাকায় বিক্রি হতো, এর দাম বেড়ে ১১৭ থেকে ১১৮ টাকায় ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা করেও ডলার বিক্রির নজির পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলার সংকটের কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এতে করে শিল্প-বাণিজ্যে সমস্যা হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান কমছে। বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার খরচ বেড়েছে। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
এদিকে রিজার্ভ সংকটের কারণে চাপে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। সবশেষ যে হিসাব কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখিয়েছে তাতে রিজার্ভ নেমে এসেছে ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
কর্মকর্তারা বলছেন, ১২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে সরকারকে শোধ করতে হবে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাকি প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ বেসরকারি খাতের। তবে সংকট শুধু বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেই নয়, বরং যেসব বিদেশি কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করেছে তাদের লাভ নেয়ার ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়েছে ডলার সংকটের কারণে।
এমন পরিস্থিতিতে ডিসেম্বরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। যেকোনো ভাবেই হোক নিট রিজার্ভ বাড়াতে না পারলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের খুব বেশি পথ নেই।
এমন প্রেক্ষাপটে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলছেন, ঋণ পরিশোধ নিয়ে চিন্তা বা উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ডলার নিয়ে কিছু টানাটানি আছে এটি সত্যি, কিন্তু সরকার পরিস্থিতি নিয়ে অবগত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে কিছু কিছু ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোর।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বর্তমান ঋণ রি-শিডিউল করার জন্য অনানুষ্ঠানিক ভাবে ঋণদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাধ্যমে রাজি করাতে না পারলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় অনুমান করাটাই কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত দেশের সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৭১ কোটি ডলার বা ৯৫.৭১ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার ও সরকারি গ্যারান্টিতে পাওয়া ঋণের যে ৩১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে তার ২৪৩ কোটি ডলার আসল। বাকি ৭৬ কোটি ডলার সুদ।
বেসরকারি খাতের ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণের মধ্যে চলতি বছর প্রথম ৬ মাসে ৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বেসরকারি খাতের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের মধ্যে ১৬২ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে আরও প্রায় ৬০০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।
আরও জানা গেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে আরও প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু চলতি বছরের প্রথমার্ধে ঋণপ্রাপ্তির যে গতি তাতে জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সর্বোচ্চ ১০-১১ বিলিয়ন পাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সাল পর্যন্ত বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে যে পরিমাণের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নিতেন, পরিশোধ তার চেয়ে কম ছিল।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে যে ডলার সংকট চলছে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এজন্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলে এসব ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করা বা পুনঃতফসিল করার কোনো বিকল্প নেই।