বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে পণ্য আমদানিই কি সমাধান?
দেশে ডিমের দাম সরকারের বেঁধে দেয়া সীমার মধ্যে রাখার উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর, সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিদেশ থেকে ডিম আমদানি করার অনুমতি দিয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিবেশী ভারত থেকে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি পেয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
এর আগে জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে টানা কয়েক সপ্তাহ কাঁচা মরিচের কেজি ৬০০ থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল বাজারে। দাম কমাতে সরকারের নির্দেশনা, ভোক্তা অধিকার অধিদফতরের অভিযান- কোনো পদক্ষেপেই যেন ঝাল কমছিল না মরিচের।
শেষ পর্যন্ত জুলাই মাসে সরকার কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই মাসের তিন তারিখে ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচামরিচের ট্রাক বাংলাদেশের সীমান্তে ঢোকার সাথে সাথে পাইকারি ও খুচরা বাজারে কাঁচা মরিচের দাম কমতে শুরু করে।
একদিনেই কাঁচা মরিচের দাম প্রতি কেজি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় নেমে আসে।
কেবল ডিম আর কাঁচা মরিচই নয়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যেমন- চাল, পেঁয়াজ, বা রোজার সময়ে ছোলা বা খেজুরের দাম বেড়ে গেলে, এক পর্যায়ে সরকারকে সেসব পণ্য আমদানি করার সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে।
যদিও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বলছে, বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে আমদানি করা একটি ‘সাময়িক’ পদক্ষেপ।
কিন্তু বিশেষজ্ঞ এবং বাজার পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, দাম কমাতে তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা হিসেবে আমদানি না করে, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
তারা সতর্ক করছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা এবং আমদানি নির্ভরতা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।
বাজারে কি সরবারহ স্বাভাবিক হয়?
গত বছর খানেক ধরে ডিম, চাল, পেঁয়াজ কিংবা ডালের মতো কোনো কোনো পণ্য, যেমন- চিনি, লবন বা সয়াবিন তেল হঠাৎ করে বাজার থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। এরপর দাম বাড়ানো কিংবা আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ওই সব পণ্যের সরবারহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে আমদানিই যেন বাজারের আগুন নেভানোর একমাত্র সমাধান।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, ‘আমরা অনুমান করছি, বাজার ব্যবাস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে ডিমের দাম বেড়েছে। এরকম ক্ষেত্রে আমদানি করে সরবরাহ বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা কঠিন।’
তিনি বলছেন, বাজারে সরবরাহের ঘাটতির কারণে পণ্য আমদানি করা হলে সেটি বাজারে তেমন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু কৃত্রিমভাবে বাজারে পণ্যের যোগান নিয়ন্ত্রণ করা হলে, সেরকম ক্ষেত্রে আমদানি করার পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে।
এই গবেষক বলেন, এরকম পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক হয় না এবং দামও কমে না।
তার উপর আমদানি যথেষ্ট পরিমাণে হলে বড় ব্যবসায়ীরা তাদের হাতে থাকা পণ্য বাজারে ছেড়ে দিতে পারেন, ফলে সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার পাশাপাশি পণ্যের দাম কমলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন।
সেই সাথে, দীর্ঘ মেয়াদে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম।
আমদানির সিদ্ধান্তে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে
যে কোনো দেশের অর্থনীতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে আমদানি নির্ভরতা দীর্ঘ মেয়াদে একটি বড় চিন্তার বিষয়। এর অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের জন্য তখন অন্যের ওপর নির্ভর করতে এবং তার পেছনে দেশের আয়ের বড় অংশটি ব্যয় করতে হবে।
এর ফলে স্থানীয় উদ্যোক্তারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ারও সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনিরুজ্জামান।
তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই কতিপয় বড় ব্যবসায়ীরা পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে থাকেন। পণ্য আমদানি করা হলে তখন তারা দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারেন। অনেকে হয়তো ব্যবসা ছেড়ে দিতেও বাধ্য হতে পারেন।
সম্প্রতি ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ডিমের খামারিরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
কারণ গত কয়েকমাসে ডিমের আড়তদাররা যে দামে খামারিদের কাছ থেকে ডিম কিনছিলেন, সেই দামের চেয়ে ডিমের উৎপাদন খরচ বেশি বলে দাবি করেন খামারিরা।
এখন উৎপাদন খরচ কমানোর ব্যবস্থা না নিয়ে ডিম আমদানি করা হলে ওই ক্ষুদ্র খামারিরা বেশি খরচে ডিম উৎপাদন করে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হবে। যেহেতু বাজারে ডিমের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
কিন্তু আমদানিকারকরা বিদেশ থেকে ডিম আনার কারণে দেশের উৎপাদন মূল্য ও বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে ডিম আনতে পারবেন এবং ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হতে পারবেন।
এমন ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের ডিম উৎপাদকদের বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ব্যবসা থেকে ছিটকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ডিমের দামও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে, উৎপাদন বাড়ানো এবং বাজার ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা।
বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে
কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলছিলেন, তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করলে, লম্বা সময় ধরে ডিম আমদানি অব্যাহত থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। তখন কতিপয় বড় ব্যবসায়ীর হাতেই থাকবে ডিমের বাজারের নিয়ন্ত্রণ।
‘এরকম পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিলে বাজারে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ তখন প্রতিযোগিতামূলক বাজার না হয়ে অলিগোপলিস্টিক মানে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যখন পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তেমন একটি বাজারের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে,’ বলেন তিনি।
এর ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এ বছরের মার্চে ব্রয়লার মুরগির বাজারে।
প্রান্তিক খামারিদের অনেকে বাজার থেকে ছিটকে যাওয়ায় পোল্ট্রি শিল্পের কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান জোট বেঁধে মুরগির দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল, বলে অভিযোগ তুলেছিল বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন।
নির্বাচন সামনে রেখে জনতুষ্টি?
সম্প্রতি ডিম ছাড়াও চিনি, ভোজ্যতেল বা চালের দাম বাড়ার ঘটনায় বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার দিকে নজর না দিয়ে পণ্য আমদানি করা বা আমদানি শুল্ক কমানোর মতো পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে।
এতে আমদানির মাধ্যমে দামে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়লে সাধারণ মানুষ খুশি থাকে। আবার অন্যদিকে, আমদানির অনুমতি পাওয়া ব্যবসায়ীদের একটি অংশও এতে লাভবান হয়।
অর্থনীতিবিদ মোয়াজ্জেম বলছেন, ‘প্রায় সব জায়গাতেই আমাদের মনে হচ্ছে যে প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাঠামো হলে যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত, নজরদারি বা ব্যবস্থা নেয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়া হত, সেই ক্ষেত্রগুলোতে আর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’
যেমনটা দেখা গিয়েছিল চলতি বছরের মার্চে।
সে সময় তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছিল, বড় কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ফেব্রুয়ারি-মার্চে মুরগির দাম বাড়িয়ে ৯০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে বাজার থেকে।
সে সময় বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন তাদের শাস্তি দাবি করলেও, কার্যত মুরগির দামের উচ্চসীমা বেঁধে দেয়া ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষকে।
জুনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের প্রসঙ্গে মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
তিনি সংসদে বলেছিলেন, ‘সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। তবে তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে। এজন্য আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্য থেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।’
তবে, মোয়াজ্জেম মনে করেন, নির্বাচনের আগে সরকার এই বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর সাথে বিবাদে জড়াতে চাইছে না, যে কারণে সাময়িকভাবে হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া পিছিয়ে দিচ্ছে তারা।
কী বলছে সরকার?
বাংলাদেশের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, বাজার থেকে ‘কথিত সিন্ডিকেট’র প্রভাব কমাতেই আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এবং বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে আমদানি করা একটি ‘সাময়িক’ পদক্ষেপ। উদাহরণ হিসেবে তিনি কিছুদিন আগে ডিমের দাম বাড়া এবং একদিনের ব্যবধানে হঠাৎ কমার বিষয়টি তুলে ধরেন।
প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘কিছুদিন আগে যখন ডিমের দাম বেড়ে যায়, তখন বাণিজ্য মন্ত্রী প্রয়োজনে ডিম আমদানির কথা বলতেই বাজারে ডিমের দাম কমে যায়। তাতেই ধারণা করা যায় যে কোনো কোনো গোষ্ঠী বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করে।’
‘আমদানি করতে দিলেই তারা শায়েস্তা হয়ে যায়। আমদানি করলে তারা দাম কমাতে বাধ্য। সরাসরি সিন্ডিকেশন খোঁজার চেয়ে এভাবেই বাজার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব,’ বলছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী।
দীর্ঘ মেয়াদে দেশীয় উৎপাদকদের রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরণের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
‘দেশীয় উৎপাদকদের রক্ষা করতে আমরা ঋণ দেব, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দেব এবং ভর্তুকি মূল্যে কাঁচামাল দেব তাদের সহায়তার জন্য। কিন্তু বাজারে দাম বাড়িয়ে রেখে আমদানি না করে তাদের সহায়তার চেষ্টা করলে, ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
সেজন্য বাজারের সিন্ডিকেটের প্রভাবে ভোক্তার ওপর যেন অতিরিক্ত চাপ না পড়ে তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার। সূত্র : বিবিসি