‘করোনা সংকটে’ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে গৃহশিক্ষকরা


নিউজ ডেস্ক

আরটিএনএন

ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জ্যোতি বুলবুল বনানীর একটি বাসায় টিউশনি করতেন। এখান থেকেই তার হাতখরচ, পড়াশোনার খরচ উঠে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই তার সেই টিউশনি বন্ধ হয়ে যায়।

তিনি বলছেন, তিনমাস পড়ানো বন্ধ ছিল। সাধারণ ছুটিতে তো সবকিছুই বন্ধ ছিল, যাতায়াত করাও সম্ভব ছিল না। এখনো বাইরে বের হওয়া, কারো বাসায় যাতায়াত তো ঠিক না। খবর বিবিসি বাংলার

এই মাস থেকে তিনি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছাত্রের অনলাইনে টিউশনি করাতে শুরু করেছেন।

তবে ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের এমবিএ-র শিক্ষার্থী নিরোধ পাল ততোটা সুবিধা পাননি।

আমি তিনটা টিউশনি করতাম। কিন্তু করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকেই সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

নিরোধ পাল বলেন, সব সাবজেক্ট তো অনলাইনে ঠিকমতো পড়ানো যায় না। এখন আমি যে কারো বাসায় যাবো, সেটা আমার জন্যেও রিস্ক, তাদের জন্যও রিস্ক। আগে টিউশনি করেই আমার ঢাকায় থাকার খরচ চলে আসতো। এখন সেজন্য বাড়ি থেকে টাকা আনতে হয়। সব মিলিয়ে একটা মানসিক চাপের মধ্যে আছি।

তার আশঙ্কা করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত হয়তো তিনি আর টিউশনি করাতে পারবেন না।

ঢাকা ও বড় শহরগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের প্রধান উৎস টিউশনি। এর মাধ্যমে থাকা-খাওয়ার খরচের পাশাপাশি পড়াশোনার খরচও উঠে আসে।

কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তাদের এই আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ নারী-পুরুষ আর ২৭ লাখ বেকার।

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এই বেকারদেরও বড় একটি অংশ আয়ের জন্য টিউশনির ওপর নির্ভরশীল।

তবে কতো মানুষ টিউশনি করেন বা কতজন এই আয়ের ওপর নির্ভরশীল, তার কোন তথ্য উপাত্ত নেই।

তবে অনেকে যেমন পড়াশোনার পাশাপাশি খরচ চালাতে টিউশনি করেন, অনেকে আবার একে পুরোপুরি পেশা হিসাবেও নিয়েছেন। অনেক এলাকায় বিভিন্ন 'স্যার' নামে এরকম পেশাদার শিক্ষকদের বিজ্ঞাপন দেখা যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর টিউশনি করাকেই আয়ের উৎস হিসাবে নিয়েছেন নাজমুন নাহার।

নাজমুন নাহার, অনেকদিন সরকারি চাকরি খুঁজেছিলাম। কিন্তু সেটা করতে করতে সরকারি চাকরির বয়স পার হয়ে গেল। স্টুডেন্ট থাকার সময় থেকেই টিউশনি করতাম। এখন পুরোপুরি সেটা করতে শুরু করেছিলাম। যা আয় হতো, তাতে আমার সব খরচ চলে যেতো। স্বামীর আয়ের পাশাপাশি এটা ছিল সংসারের বড় আয়। কিন্তু করোনাভাইরাস এসে সব উল্টে-পাল্টে দিল।

গত তিনমাস ধরে তার কোন টিউশনি নেই, কবে আবার শুরু করতে পারবেন জানেন না।

শুধু যারা টিউশনি করতেন, তারাই যে এই বিপদে পড়েছেন তাই নয়, সংকটে পড়েছেন শিক্ষার্থী বা তাদের অভিভাবকরাও।

কারণ টানা বন্ধের কারণে একদিকে সন্তানদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৬ই অগাস্ট পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তবে অনেক প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছে।

কিন্তু স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গৃহশিক্ষককে আসতে বলতে পারছেন না অভিভাবকরা। ফলে সন্তানদের পড়াশোনাও ঠিকমতো হচ্ছে না বলে অভিভাবকরা চিন্তায় পড়েছেন। মার্চ মাস থেকেই কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ রয়েছে।

ঢাকার বনশ্রীর একজন বাসিন্দা আফরোজা আক্তার বলছেন, আমার ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। টিচার না থাকলে বাসায় কোন পড়াশোনা হয় না। কিন্তু এখন যে অবস্থা, বাসায় তো কাউকে আসতেও বলতে পারি না। ছেলের ইন্টারনেটে ক্লাস হয়, শুনেছি কেউ কেউ নাকি ইন্টারনেটেও টিউশনি করায়। এখন হয়তো সেটাই চিন্তা করতে হবে।

যেসব প্রতিষ্ঠান অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে টিউশনির জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করে, তারা বলছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর থেকে টিউশনির বাজার শূন্যে নেমে এসেছে।

বিডি হোম টিউটর নামের টিউশনি খোঁজার একটি অ্যাপের অন্যতম উদ্যোক্তা মিজবুর রহমান পাটোয়ারি জানান, করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার আগে প্রতিমাসে আমরা ২০/২৫টা টিউশনির অনুরোধ পেতাম। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে সেটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন আর কোন টিউশনির অনুরোধ আসছে না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ না যাওয়া পর্যন্ত এই পরিস্থিতি খুব একটা পাল্টাবে না বলেই তার আশঙ্কা।