ভারতের নাগরিকদের হত্যা-নির্যাতনের অভিযোগ বিএসএফের বিরুদ্ধে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আরটিএনএন
ঢাকা: পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলীয় কোচবিহার জেলায় বিএসএফের গুলিতে গত দু‘বছরে অন্তত নয়জন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন বলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অভিযোগ করেছে। তারা বলছে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলায় ভারতীয় নাগরিকদের গুলি করে হত্যার সংখ্যা কমে এলেও কোচবিহার তা অব্যাহত রয়েছে।
ওই সংগঠনের অভিযোগ, হত্যা ছাড়াও নিয়মিতই সীমান্ত অঞ্চলের কৃষকদের হেনস্থা করা, এমনকি তারা কোনো ফসল চাষ করতে পারবে সেটাও ঠিক করে দিচ্ছে বিএসএফ।
বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ কোচবিহারের জেলাশাসকের কাছে একটা স্মারকলিপি দিয়ে বলেছে বিএসএফের হেনস্থা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে কাঁটাতারের বেড়ার ভেতরে তাদের চাষের জমি সরকার কিনে নিক।
এ বিষয়ে চেষ্টা করেও বিএসএফের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ, যিনি নিজেও কোচবিহারের বাসিন্দা, তিনি বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরেই বিএসএফ সীমান্তের মানুষকে হেনস্থা করে চলেছে।
এই কোচবিহারেই বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানি খাতুন। বিএসএফের গুলিতে গত বছর অন্তত ১২ জন বাংলাদেশের নাগরিক মারা গেছে।
মাছ ধরতে গিয়ে মাথায় গুলি খেয়ে মৃত্যু
কোচবিহারের গিতালদহ অঞ্চলের বাসিন্দা বিলকিস বিবির তারিখটা খুব ভাল করেই মনে আছে। সেটা ছিল ২০২২ সালের ২৯ জুন। প্রতি সন্ধ্যার মতো সেদিনও তার স্বামী মোফাজ্জল হোসেন বাড়ির কাছে বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় মাছ ধরতে যাওয়া আর মাঝ রাতে ফিরে আসা এটাই রুটিন ছিল ৩৮ বছর বয়সী হোসেনের। ওই রাতে তিনি বাড়ি ফেরেননি। সকাল হতে স্ত্রী আর আত্মীয় পরিজনরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন।
বিলকিস বিবি বলেন, ‘দুপুরের দিকে আমার স্বামীর লাশ ভাসতে দেখা যায় ওই বিলের জলেই। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। তখনই আমার খেয়াল হয় যে রাতে আমি একটা গুলির আওয়াজ পেয়েছিলাম। কিন্তু দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি সেটা আমার স্বামীর মাথায় গুলি করার আওয়াজ।’
তিনি বলছিলেন, বিএসএফ আর পুলিশ অভিযোগ করেছিল যে হোসেন পাচারকারী ছিলেন।
যে বিলের জলে হোসেনের লাশ ভাসতে দেখা গিয়েছিল, সেটা সীমান্ত থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে। তাছাড়া, হোসেন পাচারের সাথে যুক্ত যদি থেকেও থাকতেন, তাহলে তার মাথা লক্ষ্য করে গুলি কেন চালানো হল, সেই প্রশ্নও উঠেছে তার এলাকায়।
তদন্ত হয় না, মেলে না ক্ষতিপূরণ
‘আমরা সীমান্তবাসী’ নামে যে সংগঠনটি বৃহস্পতিবার জেলাশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেয়, তারা বলছে এ ধরনের কোনো মৃত্যুর ক্ষেত্রেই না হয় তদন্ত, না দেয়া হয় ক্ষতিপূরণ।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে সরব মানবাধিকার সংগঠন মাসুমের প্রধান কিরীটী রায় বলেন, ‘মোফাজ্জল হোসেনের মতো অন্তত নয়জন ভারতীয় নাগরিক গত প্রায় দু‘বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। কোনো তদন্ত হয়নি কোনো ঘটনাতেই, কেউ ক্ষতিপূরণও পায়নি। অথচ রাজ্য সরকারের চাপের ফলে অন্যান্য জেলাগুলিতে সীমান্তে ভারতীয় নাগরিক হত্যা বা সেখানকার কৃষকদের নিয়মিত হেনস্থা অনেকটাই কমে এসেছে। ব্যতিক্রম কোচবিহার।
কিরীটী রায় বলেন, ‘বিএসএফ সবসময়ে বলে থাকে যে কোচবিহার সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছে। অথচ তাদের বর্ডার পাহারা দেয়ার কথা, সেখানে তারা নেই, অনেক দূরে ভারতের অভ্যন্তরে তাদের দেখতে পাওয়া যায়। চোরাচালান যা হচ্ছে সেটাতে বিএসএফই মদত দিচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনও সব জানে, কিন্তু তারাও কিছু করে না।’
মোফজ্জল হোসেনের স্ত্রী বলছিলেন, সেই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ছিল। সে চলে যাওয়ায় এক কন্যাসন্তান নিয়ে খুব কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছি।’
কী চাষ করবেন কৃষকরা, সেটাও বিএসএফই ঠিক করে
কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে যেসব কৃষকদের জমি আছে, সেখানে তারা রোজ যেতে পারেন, কিন্তু সময় ধরে যেতে আর বেরতে হয় নির্দিষ্ট গেট পেরিয়ে, পরিচয়পত্র দেখিয়ে।
এই নিয়ম অনেকদিন ধরেই মেনে চলেন সীমান্তবাসীরা। তবে কয়েকবছর ধরে বিএসএফ ওই জমিগুলিতে পাটের মতো যেসব ফসল উঁচু হয়, সেগুলি চাষ করতে দেয় না। তারা বলে লম্বা পাট গাছের মধ্যে দিয়ে যদি চোরাচালান হয়, তাহলে তা বিএসএফের নজরে পড়বে না।
কিন্তু ‘আমরা সীমান্তবাসী’ সংগঠনটি দাবি তুলেছে আমার জমিতে আমি কী চাষ করব তা স্থির করার দায়িত্ব আমার। বিএসএফ বা অন্য কেউ আমার সেই অধিকার হরণ করতে পারে না।
সীমান্তবাসীরা বলেন, দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে কাঁটাতারবন্দী জমি যদি সরকারের প্রয়োজন হয়, তাহলে তা অধিগ্রহণ করা হোক আর আমাদের ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন দেওয়া হোক।’
ইতোমধ্যেই বিএসএফের বাধার কারণে চাষের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জন্য প্রতি বছর বিঘা প্রতি ৩০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন কৃষকরা।
এসব দাবি বৃহস্পতিবার জেলা শাসকের কাছে জমা দেয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেছে ‘আমরা সীমান্তবাসী’ সংগঠনটি।
পাচারকারী মারা যায়, কিন্তু পাচারের জিনিস ধরা পড়ে না
গিতলদহের মোফাজ্জল হোসেনকে পাচারকারী বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি ঠিক কী পাচার করছিলেন, তা জানে না তার পরিবার।
‘গরু পাচারকারী ধরা পড়ে বা বিএসএফের গুলিতে মারা যায়, অথচ পাচারের জিনিস ধরা পড়েছে এমন ঘটনা দেখা যায় না। পাচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হলে গরু বা সোনা তো থাকবে পাচারকারীর সাথে! সেগুলো কোথায়?’ প্রশ্ন তুললেন কোচবিহারের বাসিন্দা ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ।
‘এর থেকেই তো বোঝা যায় যে এগুলো সব সাজানো ঘটনা।’
তার কথায়, ‘বিএসএফ দীর্ঘদিন ধরেই এই জিনিস করে আসছে। কৃষকদের তিন ফুটের বেশি উচ্চতার ফসল চাষ করতে দেয় না। নানাভাবে হেনস্থা করা হয় সীমান্ত অঞ্চলের মানুষকে। কয়েক দিন আগে আমার এই দিনহাটা শহরে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে তল্লাশি করে গেছে। ওদের সীমা যে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, সেখানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এসব করছে।’
তিনি বলেন, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এবং দলীয়ভাবেও বিএসএফের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন।
উত্তরাঞ্চলীয় অন্য জেলাগুলি বিএসএফের উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের অধীনে থাকলেও কোচবিহার জেলা বিএসএফের গুয়াহাটি ফ্রন্টিয়ারের অধীন।
বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগগুলো নিয়ে বিএসএফের গুয়াহাটি সীমান্ত অঞ্চলের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বিবিসি।