কাটার মাস্টার মুস্তাফিজের উত্থান-পতন ও ফিরে আসার গল্প


খেলা ডেস্ক

আরটিএনএন

ঢাকা: ঢাকায় ফিরেই কোয়ারেন্টিনে চলে গেছেন মুস্তাফিজ - এই খবর ক্রিকেট নিয়ে যারা টুকটাক খোঁজ রাখেন তাদের সবারই জানা। তবে কোয়ারেন্টিনে সময়টা অবশ্য মোটেও ভালো কাটছে না তার। তিনি নিজেই জানালেন, এর চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না।

সময়-সুযোগ মিললেই যিনি অবধারিতভাবে সাতক্ষীরায় চলে যান, সেই মুস্তাফিজুর রহমানের প্রায় ৭০ দিন কেটে গেল ক্রিকেট মাঠ আর হোটেলের রুমে রুমে। খবর বিবিসি বাংলার

যেহেতু কোয়ারেন্টিনে, তাই সামনা-সামনি দেখা হওয়ার জো নেই। ভরসা টেলিফোন - আর তাতেই তিনি বলেন, বাড়ি ফিরতে না পারার কষ্টটাই এখন তার ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

কিন্তু ফিরেছেন তো মাঝ পথে থেমে যাওয়া আইপিএল থেকে, খেলা নিয়ে আলাপই ছিল তাই মুখ্য।

এবারের আইপিএলে জস বাটলারের সাথে মুস্তাফিজের কথপোকথন ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। টেলিভিশন স্ক্রিনে দুজনের কথা বলা দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন - খুব বেশি ইংরেজি না জানা মুস্তাফিজ কী এমন বলছেন ইংলিশম্যান বাটলারকে!

কী কথা ছিল তাহার সনে - এমন প্রশ্ন রাখতেই মুস্তাফিজ খানিকটা ভেবে বলেন, ক্রিকেটের টার্ম তো সবখানেই এক। আসলে অমন আহামরি গোপন কোন কথা হয়নি। কোথায় ফিল্ডার রাখলে সুবিধা, কোন লাইনে বল করলে ভালো - মূলত এগুলোই ছিল দুজনের মধ্যে কথাবার্তা।

অধিনায়ক সাঞ্জু স্যামসন ও বোলিং পার্টনার সাকারিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছে স্বভাবে খানিকটা খানিকটা অন্তর্মুখী এবারে রাজস্থান রয়্যালসে খেলা মুস্তাফিজের।

অনেকেই একে উন্নতির সিঁড়িতে একটা ধাপ হিসেবে দেখছেন, কারণ বৈশ্বিক ক্রিকেটের আবহে মুস্তাফিজুর রহমান যতটা খোলামেলা হবেন, ততই শিখবেন, জানবেন, এবং সেটা তার খেলায় ছাপও ফেলবে।

এর আগে তো মুম্বাই ইন্ডিয়ানস দলে তার সঙ্গে বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার নাফিস ইকবালকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, শুধুমাত্র যোগাযোগের সমস্যা মেটাতে।

তবে দলে এবার মাঠে না নামা এক তারকাও আছেন - কুমার সাঙ্গাকারা। মুস্তাফিজ মনে করিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেও সাঙ্গার সাথে খেলা হয়েছে তার, এটা নতুন কিছু না।

আইপিএলে খেলাটা মুস্তাফিজকে অনুপ্রাণিত করে। ডাক পেলে মনে হয় যে তিনি এখনও আছেন আলোচনায়। কিন্তু মুস্তাফিজ কি কখনও আলোচনা থেকে সরে গিয়েছিলেন?

এই মুস্তাফিজ, সেই মুস্তাফিজ

২০১৫ সালে রূপকথার মতো শুরু মুস্তাফিজের। এরপর নিজেকে আরও শানিত করেন ২০১৬ সালে। বিভিন্ন ফরম্যাটে ক্যারিয়ারের প্রথম উইকেটের তালিকা দেখলেও তার দেয়া চমকের একটা ধারণা পাওয়া যায়।

টি-টোয়েন্টিতে শহীদ আফ্রিদি, টেস্টে হাশিম আমলা, ওয়ানডেতে রোহিত শর্মা আর আইপিএলে গিয়েই এবি ডি ভিলিয়ার্স।

আর সেবারে আইপিএলেও মুস্তাফিজ ছিলেন নায়ক, ডেভিড ওয়ার্নার তো ভূয়সী প্রশংসায় ভাসিয়েছেন সাতক্ষীরার কাটার মাস্টারকে।

আইপিএল ইতিহাসে একমাত্র অভারতীয় ক্রিকেটার মুস্তাফিজ, যিনি ইর্মাজিং ক্রিকেটার অফ দ্য সিজন পুরষ্কার পান।

কিন্তু তারপরই ছন্দপতন - সমালোচক থেকে বিশ্লেষক সবাই লিখতে আর বলতে থাকলেন মুস্তাফিজ হারিয়ে গেছেন। মুস্তাফিজের ভাষায় অবশ্য পুরো বিষয়টাই ছিল ভাগ্যের দোষ।

মাত্রই আলো ছড়াতে শুরু করেছেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের সেই একেবারে গোড়ার দিকে মুস্তাফিজুর রহমান চোট পান বোলারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কাঁধে।

অনেকেই এই রায় ঘোষণা করেছিলেন - মুস্তাফিজ আর কখনও ফিরে আসবেন না।

মুস্তাফিজ বলেন, একেবারে খারাপ কিন্তু করিনি। তবে যেটুকু খারাপ করেছেন তাতে ইনজুরির ভূমিকাই বেশি ছিল বলে মনে করেন তিনি।

দেখুন, আমি যে বলটা করি সেটা বা-হাতের স্পিন বলা যায়, অফ স্ট্যাম্পের বাইরের দিকে যায়। এমন বল ১২৫ থেকে ১৩৫ কিলোমিটার গতিতে করতে গেলে কাঁধে বাড়তি জোর লাগে, যা করাটা সার্জারির পর খানিকটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, কনুইয়ে ব্যথা অনুভব করতেন বলে জানালেন মুস্তাফিজ। তাই তার প্রিয় ডেলিভারি, যেটাকে স্টক বল। সেই কাটার থ্রো করতে সমস্যাই হচ্ছিল এক রকম।

সার্জারির আগে-পরে মুস্তাফিজের পরিসংখ্যান দেখলেও তার কথার পক্ষে যুক্তি মেলে।

জাতীয় দলে তার শুরুর বছরটিতে, ২০১৫ সালে, মুস্তাফিজ ৭৫ ওভারের মতো বল করে পেয়েছিলেন ২৬টি উইকেট।

আর ২০১৭ সালে ৮৩ ওভারে পেয়েছেন ১৪টি উইকেট।

তবে মুস্তাফিজ চোট থেকে ভালোভাবে ফিরেছেন বেশ কয়েকবারই। ২০১৯ সালে তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হলেও ২০১৮ সাল তিনি কাটিয়েছেন একজন পেস বোলারের স্বপ্নের বছরের মতো।

সেবার নিদাহাস ট্রফিতে ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল জমিয়ে তুলেছিলেন মুস্তাফিজ এক ওভারে।

কাটারের পর কাটার, এমন কাটার জীবনেও দেখিনি কিশোরগঞ্জে এক জনসভায় এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কণ্ঠে।

ভারতের সাথে দুটো ম্যাচে - নিদাহাস ট্রফির ফাইনাল ও এশিয়া কাপের ফাইনাল - বাংলাদেশের বেশ হৃদয়বিদারক পরাজয় ঘটেছিল সেবার, তবে বাংলাদেশকে যদি কেউ জয়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে থাকেন, তিনি সেই মুস্তাফিজই।

২০১৮ সালে মুস্তাফিজুর রহমান প্রায় ১৫০ ওভার বল করে ২৯টি উইকেট নেন। গড় ছিল ২১, ইকোনমি রেট ৪.২০।

সেবার গোটা বিশ্বজুড়েই ম্যাচ খেলেছেন তিনি - বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আমেরিকা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, দুবাই।

সবখানেই নিজের মেধা আর দক্ষতার ছাপ রাখেন। কিন্তু পরের বছর সেটা আর চালিয়ে নিতে পারেননি তিনি।

তার ক্ষেত্রে ২০১৫ সালটা অস্বাভাবিক রকমের ভালো। প্রতি বছর সেই পারফরমেন্সের পুনরাবৃত্তি করা গেলে মুস্তাফিজ হতেন সময়ের সেরা পেস বোলার।

মুস্তাফিজকে নিয়ে গবেষণা

কিন্তু চোটের সাথে আরও একটা জিনিস ছিল মুস্তাফিজের অন্তরায়। তাহলো, মুস্তাফিজ যে ডেলিভারিতে রোহিত শর্মা, ধোনি, রায়নার মতো খেলোয়াড়কে সাজঘরে ফেরাতেন, সেটা তখন সবার কম্পিউটারে গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাটসম্যানরা ধরে ফেলেন, অপেক্ষা করে দেরিতে মারলেই যে হয়!

মুস্তাফিজের ইকোনমি রেট দেখলেও এটা বোঝা যায় যে তার রহস্য খানিকটা হলেও উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। ২০১৬ সালে মুস্তাফিজের আইপিএল ইকোনমি রেট ছিল সাতের নিচে, এখন সেটা সাড়ে আট ছুঁই ছুঁই।

বাহাতি মুরালিধরন, মুস্তাফিজুর রহমান এই উপাধি স্থগিত হওয়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে পেয়েছেন।

জোরের ওপর করা বল যখন লেগ স্ট্যাম্পে পড়ে গতি বদলে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের লাইনে যায়, তখন ব্যাটসম্যানরা অনেক সময়ই ব্যাটের গতি সামলাতে পারেন না, বল উঠে যায় মিড অন কিংবা ৩০ গজের বৃত্তের ভেতর কোন ফিল্ডারের হাতে। সহজ ক্যাচ হয়ে ব্যাটসম্যান ফিরে যান প্যাভিলিয়নে।

মুস্তাফিজুর রহমানের বোলিং ক্যারিয়ারে এই ধরনের উইকেট খুবই পরিচিত, ট্রেডমার্ক বলা যায় যাকে।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন নতুন ক্রিকেটার খোঁজা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল, তখন মুস্তাফিজুর রহমান এসেছিলেন আশার আলো হয়ে। নির্বাচক, অধিনায়ক, টিম ম্যানেজমেন্ট-সহ পুরো ইউনিট হাফ ছেড়ে বাঁচে তাকে পেয়ে। তাদের কাছে, মুস্তাফিজ মানেই খানিকটা নির্ভার হওয়া।

কিন্তু দ্রুতই আধুনিক ক্রিকেটের আতসী কাঁচের নিচে পড়ে যাওয়া মুস্তাফিজকে নতুন পথ বাতলে দেননি কেউ - অনেকটা হতাশার সুরে বলছিলেন মুস্তাফিজই।

কোচদের ভূমিকা কমই ছিল

বাংলাদেশের যখন একটা সমীহ করার মতো পেস বোলিং ইউনিট তৈরি হয়েছিল, তখন বোলারদের নিয়ে কাজ করতেন জিম্বাবুয়ের সাবেক অধিনায়ক হিথ স্ট্রিক।

মাশরাফী, তাসকিন, রুবেল ... সাথে যোগ হয়েছিলেন মুস্তাফিজ।

এরপর বোলিং গুরুর জায়গা নিলেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তী কোর্টনি ওয়ালশ। কিন্তু মুস্তাফিজকে নিয়ে শুরুতে বাড়তি কাজ করার প্রয়োজন হয়নি।

প্রয়োজন যখন হয়েছে, তখন আর তাকে নিয়ে আলাদা কাজ করাই হয়নি। মুস্তাফিজের বোলিং তাই অনেকটা পানশে হয়ে যায় একটা সময়।

মুস্তাফিজ বলেন যে কোন কোচ তাকে অ্যাকশনে পরিবর্তন বা এ ধরণের কোন পরামর্শ দেয়নি। "নিজে নিজেই কাজ করেছি। দলের সিনিয়রদের সাথে কথা বলেছি।"

বিশেষ বোলারদের ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন, প্রকৃতিপ্রদত্ত গুণের সাথে বাড়তি অস্ত্রের দিকেও নজর দেন কোচরা। কিন্তু মুস্তাফিজের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।

ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত

এবারের আইপিএলে মুস্তাফিজের জন্য ছিল বিশেষ কিছু। খুব একটা ফর্মে ছিলেন না, তবু ডাক পেয়েছেন।

কোটি টাকা মূল্যও পেয়েছেন। উসুলও করেছেন তা।

জফরা আর্চার ও বেন স্টোকসের চোট মুস্তাফিজের নিয়মিত একাদশে থাকা নিশ্চিত করেছিল, তবে পারফর্ম করে এর যৌক্তিকতাও প্রমাণ করেছেন।

সাত ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ। যার মধ্যে ম্যাচ জেতানো ২০ রানে তিন উইকেটও ছিল তার পুরোনো দল সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে।

কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে তার বলে ওঠা ক্যাচগুলো ধরলে উইকেট সংখ্যা হয়তো ১০ ছাড়িয়ে যেত।

কোন কিছুতে অবাক হয়েছেন মুস্তাফিজ, এমন খুব একটা দেখা যায় না - সবকিছুতে নির্লিপ্ত একটা ভাব।

এবারের আইপিএল-এ ভালো কীভাবে করলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমনিতেই হয়ে গেছে। তবে দলের বাকিদের কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তিনি। বলেছেন, সবাই সাহায্য করেছে।

রাজস্থানে মুস্তাফিজ আসেন বাড়তি পেসার হিসেবে, প্রথম একাদশে টিকবেন কি-না সেটাই ছিল আলোচনার বস্তু। কিন্তু আর্চারের চোট সুযোগ এনে দেয় তাকে। দুই ম্যাচে পিটুনি খেয়েছেন ঠিকই, তবে ম্যাচ জেতানো বোলিংও করেছেন।

ততটা খারাপ করিনি, যতটা মানুষ বলে।

তার কথায়: খেলা আজকে ভালো হবে, কাল খারাপ হবে, এটাই নিয়ম। সব দিন তো আর এক যায় না।

উন্নতির কথাই যেহেতু হচ্ছিল, আরেকটা উন্নতির কথা না বললেই নয় - মুস্তাফিজ এখন গোটা কয়েক শব্দ ব্যয় করে সাক্ষাৎকারের সময় প্রশ্নের জবাব দেন। বছর চারেক আগে এই কটি শব্দও তার মুখ থেকে শোনা ছিল বিরল ঘটনা।

যেসব জায়গায় মুস্তাফিজ বিশেষ

তিন ম্যাচের কোন আন্তর্জাতিক ওয়ানডে সিরিজে মুস্তাফিজের নেয়া উইকেটের সমান সংখ্যক উইকেট কেউ পায়নি কখনও। ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ৩ ম্যাচে তিনি পেয়েছিলেন ১৩ উইকেট।

মুস্তাফিজ ওয়ানডে ও টেস্ট ফরম্যাটে অভিষেকেই ম্যাচ সেরার পুরষ্কার পেয়েছেন। ওয়ানডে ভারতের বিপক্ষে, টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।

অভিষেক ম্যাচেই পাঁচ উইকেট পাওয়া বোলারদের তালিকায় আছেন মুস্তাফিজুর রহমান।

টানা দুই ম্যাচে ৫ উইকেট নেয়াদের তালিকায় সাকলাইন মুশতাক, ওয়াকার ইউনিসের সাথে আছে মুস্তাফিজের নাম। একবার নয়, দুইবার। ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে, আর ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে।

বোলারদের স্ট্রাইক রেটের তালিকায় মুস্তাফিজ বিশ্বে ছয় নম্বরে আছেন। প্রতি ২৬.৬ বলে একটি করে উইকেট নিয়েছেন মুস্তাফিজ।