‘গণহত্যার সময় মুসলিমদের সহানুভুতিতে হাজার হাজার রুয়ান্ডান খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করে’


আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আরটিএনএন

কিগালি: ‘গণহত্যা শুরু হওয়ার পূর্বে আমি ছিলাম একজন ক্যাথলিক ধর্ম যাজক’- বার্তা সংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইসলাম গ্রহণকারী মাতাবারো সুলাইমান এমনটি বলেন। এসময় তাকে একটি লম্বা জুব্বা পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়।

১৯৯৪ সালে যখন রুয়ান্ডার গণহত্যা শুরু হয় তখন তার বয়স ছিল ৪৯ বছর এবং তিনি গণহত্যায় নিজের স্বচক্ষে তার ধর্ম প্রচারের কেন্দ্রস্থল চার্চের ভূমিকা দেখে অবাক হয়ে যান।

সুলাইমান বলেন, ‘খ্রিষ্টানরা চার্চের ভেতরেই মানুষদের এনে হত্যা করতে শুরু করলো।’

তিনি বলেন, ‘আক্রান্তরা চার্চকে নিরাপদ ভেবে তাতে আশ্রয় নেয় এবং সেখানে শান্তির বদলে তারা নিজেদের মৃত্যু খুঁজে পায়।’

তিনি আরো বলেন, ‘আর অন্যদিকে আমি মুসলিমদের দেখেছিলাম মানুষকে মসজিদের ভেতর আশ্রয় দিচ্ছিল।’

১৮৮৪ সালে ইউরোপের উপনিবেশ শুরু হওয়ার পর থেকে রুয়ান্ডায় রোমান ক্যাথলিজম প্রভাবশালী ধর্ম হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করে।

কিন্তু পরবর্তী ২৫ বছরের মধ্যেই অনেক রুয়ান্ডান খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি নিজেদের আস্থা আর বিশ্বাস হারিয়ে পেলে এবং খ্রিস্টান ধর্মের বিকল্প হিসেবে ইসলামের উত্থান হতে থাকে।

রুয়ান্ডার সাবেক মুফতি সালিম হাবিমানার মতে, গণহত্যার পূর্বে রুয়ান্ডায় মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ১ শতাংশ। আর বর্তমানে ‘রুয়ান্ডার মোট জনগোষ্ঠীর ১২ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম।’

কোনো আশ্রয়স্থল নেই

কয়েক দশক ধরে রুয়ান্ডার টুটসি অধিবাসীদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত নেতিবাচক প্রচারণার ফল হিসেবে ১৯৯৪ সালে গণহত্যা শুরু হয়। টুটসিদের বিরুদ্ধে এমনভাবে ঘৃণা ছড়ানো হয় যাতে করে এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি।

অনেকে চার্চ সমূহকে নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে বেঁচে নিয়েছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তার আরাধনার এসব ঘর তখন কসাই খানায় রূপ নিয়েছিল।

রুয়ান্ডার চার্চ সমূহে হাজার হাজার টুটসিদের হত্যা করা হয়েছিল, এমনকি দেশটির সবচেয়ে বড় ক্যাথলিক চার্চ সেইন্ট ফামিলে নিজেকে সবচেয়ে বড় কসাইখানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।

সেইন্ট ফামিল চার্চে আশ্রয় গ্রহণকারীদের মধ্যে অন্তত ২,০০০ জন টুটসিকে হত্যা করা হয়েছিল চার্চটির যাজক ওনচেসালাস মুনইয়েয়াকার প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে।

রুয়ান্ডার দক্ষিণ কিগালি নামক শহরের নাইয়ামাতা নামক চার্চ অন্তত ৫০,০০০ হাজার মানুষের কবরে পরিণত হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের শিকার অনেকের পোশাক-আশাক এখনো চার্চের অভ্যন্তরে রক্ষিত আছে।

তথাপি চার্চ যখন কসাইখানায় রূপান্তরিত হয়েছিল ঠিক একই সময় দেশটির সংখ্যালঘিষ্ঠ মুসলিমরা তাদের মসজিদ সমূহকে খুলে দিয়েছিল শেষ নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে।

তারা সহায়তার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল

সুলাইমান তার কণ্ঠ উচ্চ করে বলেন, মুসলিমরা টুটসিদের বিরুদ্ধে এই গণহত্যায় অংশ নিতে অস্বীকার করেছিল এবং তারা নিরীহ মানুষদের সুরক্ষা দিতে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।

সুলাইমান বলেন, ‘সেসময় মুসলিমদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা এবং তাদের ক্ষমতাও ছিল সীমিত। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারে এমন নিরীহ মানুষদের সহায়তা করবে বলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘আমি দেখেছি, এই অল্প সংখ্যক মুসলিম অন্যদের সহায়তা করার মত অসাধারণ কাজ করেছিল।’- এমন মন্তব্য করার সময় তার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠে এবং তার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে।

সুলাইমান বলেন, ‘যখন এমন বিপদের সময় মুসলিমদের সহায়তা করার এমন দৃশ্য নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলাম তখন আমি চিন্তা করলাম হয়ত এটিই ইসলামের বাস্তবতা। তারা আসলে এতদিন এমন ইসলামের কথা আলোচনা করতো।’

তিনি বলেন, ‘এরপর আমি মুসলিম হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

বর্তমানে সুলাইমান খ্রিস্টান যাজকদের সাথে বিভিন্ন বিতর্ক অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং শত শত দর্শকদের সামনে রুয়ান্ডার গণহত্যায় মুসলিমদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। তিনি ইসলামের প্রচারের জন্য গ্রামের পর গ্রাম সফর করেন।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তার পাশে নাদাগিজিমানা ইব্রাহীম নামের একজন বসা ছিল। নাদাগিজিমানা ইব্রাহীম তার ১৪ বছর বয়সের সময় ঘটে যাওয়া গণহত্যায় তার বাবাসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের হারান।

তিনি কোনো রকমে পালিয়ে হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি স্নাতকোত্তর শেষ করে পিএইচডি ডিগ্রি নিচ্ছেন।

তিনি সুলাইমানের সাথে যোগ করেন, কিভাবে মুসলিমরা গণহত্যার সময় অন্যদের সহায়তা করেছিল তার বর্ণনা দেন। তিনি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে গণহত্যা শুরু হলে রুয়ান্ডার মুফতি মুসলিমদের কে যে কোনো ধরণের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন এবং যুক্তি দেন যে, ইসলাম ধর্মে নিরপরাধ নাগরিকদের হত্যা করা জঘন্য পাপ।

ইব্রাহিম বলেন, ‘মুসলিমরা টুটসি পরিবার সমূহকে লুকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিল।’

তিনি বলেন, ‘খ্রিস্টানদের একটি বৃহৎ অংশ যখন দেখেছিল যে, মুসলিমরা গণহত্যার সময় তাদেরকে নিরাপদ থাকতে সাহায্য করেছিল এবং গণহত্যার পর তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।’

এমন উদাহরণের কমতি নেই

মবারুসহিমানা হুসাইনের বয়স যখন চার তখন এমন গণহত্যা শুরু হয় এবং তিনি আর তার পিতামাতা একটি মসজিদে কয়েক মাস যাবত লুকিয়ে ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘যদিও সেসময় আমার বয়স চার বছর ছিল কিন্তু এর পরেও আমি সেই মুসলিম মানুষটির কথা ভুলি নি।’

হুসাইন বলেন, ‘এমন গণহত্যার মধ্যেও মুসলিম যুবকেরা প্রতিদিন বাহিরে খাবারের খোঁজে যেত এবং মসজিদে আশ্রিত ৪০ জন অমুসলিমের জন্য খাবার নিয়ে আসত।’

তিনি বলেন, ‘গণহত্যার দশ বছর পর আমি আমার পিতা মাতার সাথে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি।’

‘আমরা কখনো মুসলিমদের এমন দয়া সম্পর্কে ভুলে যেতে পারবো না।’

মসজিদ সমূহকে শয়তানের ঘর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল

রুয়ান্ডায় উপনিবেশের পূর্বে মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বিস্তারের জন্য এসেছিল এবং তার এখানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি বরং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসেছিল।

তথাপি, শিক্ষিত মুসলিম ব্যবসায়ীদের সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহারের ফলে তারা সহজেই স্থানীয় অধিবাসীদের বন্ধুতে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে স্থানীয় কিছু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে।

শেইখ হাবিমানা বার্তা সংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, যখন রুয়ান্ডার মাটিতে বেলজিয়ামের ঔপনিবেশিকেরা এসে উপস্থিত হয় তখন মুসলিমরা এখানে তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান হারাতে থাকে।

তিনি বলেন, ‘বেলজিয়ামের উপনিবেশিক শাসকরা মুসলিমদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা শুরু করে এবং তাদেরকে ‘খ্রিষ্টান বিরোধী’ হিসেবে প্রচার চালাতে থাকে। এমনকি সেসময় মুসলিমদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা আর শিক্ষা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।’

আর স্বাধীন রুয়ান্ডায় উপনিবেশিক রুয়ান্ডার আদলে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য অব্যাহত থাকে।

তিনি বলেন, ‘ধীরে ধীরে অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। সরকার মুসলিমদের বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে এবং তাদের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা শুরু করে।’

আর হুতু শাসক গোষ্ঠী মুসলিম বিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে একসময় মসজিদ সমূহকে শয়তানের ঘর হিসেবে আখ্যায়িত করে এমনকি তারা মুসলিমদের সাথে হাত মেলাতে পর্যন্ত কুণ্ঠাবোধ করতো।

১৯৯৪ সালের পরবর্তী রুয়ান্ডার মুসলিমরা

শেইখ হাবিমানা যুক্তি দিয়ে বলেন যে, রুয়ান্ডার মুসলিম সমাজ শুধুমাত্র তাদের সংখ্যার দিক থেকেই নয় বরং এখানকার সমাজের বিভিন্ন সমস্যার জন্য ইসলামকে অন্যতম সমাধান হিসেবে উপস্থাপন করছে।

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য রুয়ান্ডানদের মত আমরা মুসলিমরা কূটনীতি, সেনা অফিসার এবং আইন সভার সদস্যসহ রুয়ান্ডার সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখছি।’

একটি সুসংগঠিত সংখ্যালঘু দল হিসেবে মুসলিমরা রুয়ান্ডার সমাজে অবদান রাখছে এবং তাদেরকে এখন খুবই সম্মানের চোখে দেখা হয়।

হাবিমানা বলেন, ‘এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মুসলিমরা যে কাজেই নিযুক্ত হোক না কেন তারা অন্যান্য রুয়ান্ডানদের চাইতে বেশী কাজ করে। শুধুমাত্র মুসলিমরা বেশি কাজ করে এমনটি দেখানোর জন্য নয় বরং মুসলিমরা পারে এমনটি দেখানোর জন্য।’

তিনি বলেন, ‘রুয়ান্ডার গণহত্যার সময় মুসলিমদের সৌহার্দপূর্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে হাজার হাজার খ্রিস্টান রুয়ান্ডান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।’

‘সুতরাং ভালো ব্যবহারই যথেষ্ট, এটি সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে সক্ষম।’- শেষে তিনি এমনটি বলেন।

সূত্র: টিআরটিওয়ার্ল্ড ডট কম।