কেন পুতিনকে প্রয়োজন এরদোগানের?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আরটিএনএন

আঙ্কারা: ইদলিব প্রদেশের সারাকেব শহরে গত মাসে সিরিয়ার এক বিমান হামলায় একসাথে ৩৩ জন তুর্কি সৈন্যের মৃত্যুর ঘটনায় একই সাথে ক্ষুব্ধ এবং টালমাটাল হয়ে পড়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান।

যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সারাকেবে বোমা হামলার লক্ষ্য ছিল বিদ্রোহীরা, কিন্তু পরে বেশ কিছু গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে বিদ্রোহীদের সাথে যে তুর্কি সৈন্যরাও ছিল তা জেনেও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সাহায্যে সিরিয়া সেখানে হামলা চালায়। খবর বিবিসি বাংলার

গত ৩০ বছরে তুরস্কের সেনাবাহিনীতে একটি হামলায় এত বেশি প্রাণহানি হয়নি। এরপরও কেন ইদলিবে সিরিয়ার সাথে লড়ই বন্ধ করতে চাইছেন এরদোগান?

প্রথম কথা, সিরিয়ায় সেনা মোতায়েন নিয়ে তুরস্কের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য নেই।

এরপর প্রায় ৫৫ জন সৈন্যের মৃত্যুর পর বিরোধী কিছু রাজনীতিক এরদোগানকে পরোক্ষভাবে দায়ী করতে শুরু করেছেন। তারা বলছেন, ইদলিবের আকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না নেওয়ার আগে সিরিয়ায় সৈন্য ঢুকিয়ে তাদেরকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে সরকার।

অভ্যন্তরীণ চাপকে অবশ্য তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট এরদোগান।

কিন্তু তারপরও কেন তিনি ইদলিবে সংঘর্ষ বন্ধ করতে চাইছেন?

সাংবাদিক জনাথন মার্কাস বলছেন পুতিনকে চটানো এরদোগানের পক্ষে সম্ভব নয়।

কারণ এরদাগানের পছন্দ হোক আর না হোক, সিরিয়ার সঙ্কটে রুশ প্রেসিডেন্ট নিজেকে প্রধান ক্রীড়নক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন, এবং তার লক্ষ্য খুব পরিষ্কার, কোনোভাবেই বাশার আল আসাদের পরাজয় পুতিন চাইছেন না।

মার্কাস বলছেন, আফগানিস্তান এবং ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপ করার সময় পশ্চিমা শক্তিগুলোর পরিষ্কার কোনো লক্ষ্য ছিলনা। কিন্তু রাশিয়া জানে কেন তারা সিরিয়ায় গেছে, এবং সেই উদ্দেশ্য থেকে তারা একপাও হটেনি এবং যে কোনো মূল্যেই তারা সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়।

সিরিয়া ও রাশিয়ার যৌথ বিমান হামলায় সিরিয়ায় শহরের পর শহর থেকে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হয়েছে।

লন্ডনে গবেষণা সংস্থা আইআইএসএস এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক এমিল হোকায়েমকে উদ্ধৃত করে জনাথন মার্কস বলছেন, সিরিয়ায় যে মানবিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা শুধু যুদ্ধের পরিণতিতে হয়নি, শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট আসাদের কৌশলই ছিল কিছু কিছু এলাকা জনশূন্য করে ফেরা।

হোকায়েম মনে করেন, এভাবে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে ‘অস্ত্র’ হিসাবে ব্যবহার করে সিরিয়া এবং রাশিয়া তুরস্ক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর চাপ তৈরি করতে চেয়েছে।

ফলে এখন যখন সিরিয়া এবং তুরস্ক মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে, যুদ্ধবিরতির জন্য মি. পুতিনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া মি. এরদোয়ানের উপায় কি?

কিন্তু ইদলিবে যুদ্ধবিরতি নিয়ে যে মীমাংসাই মস্কোতে হোক না কেন, তা কি টিকবে?

জনাথন মার্কাস মনে করছেন সম্ভবত টিকবে না।

কারণ তুরস্ক জানে ইদলিব নিয়ে তারা যদি পিছু হটে, তাহলে সিরিয়ায় অন্যান্য যে এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেগুলোতেও সিরিয়া আক্রমণ করতে পারে।

সেটি তুরস্কের সমস্যা, কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো রাশিয়া ঠিক কি চাইছে? এবং সেটা পশ্চিমা শুক্তিগুলোর জন্য কতটা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে?

সিরিয়ার সাথে সাবেক রাশিয়ার সখ্যতা সাবেক সোভিয়েত সময় থেকেই। অনেক আগে সেখানে সোভিয়েত একটি নৌ ঘাঁটি ছিল। কিন্তু সিরিয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপের পর সেই নৌ ঘাঁটি এখন অনেক বড় এবং সেই সাথে পুরাদস্তুর একটি বিমান ঘাঁটি রাশিয়া তৈরি করেছে।

সিরিয়ার সাথে যে রাশিয়ার সম্পর্ক সম্পর্ক শুধু ঐতিহাসিক তাই নয়, এটি এখন বিশ্ব-রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিরিয়ার মাধ্যমে রাশিযা এখন একটি বার্তা দিতে চাইছে - রাশিয়া কথা রাখে এবং বিশ্বস্ত বন্ধু।

সিরিয়ায় তাদের এই ভূমিকার জন্য রাশিয়া এমনকী নেটো জোটের সদস্য তুরস্ককেও কাছে টানতে সমর্থ হয়েছে।

পশ্চিমাদের প্রতি বিরক্ত মি. এরদোয়ান এমনকী রাশিয়ার এস৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যন্ত কিনেছেন। শাস্তিস্বরুপ আমেরিকা তুরস্ককে তাদের অত্যাধুনিক এফ৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি স্থগিত করে, যেটা রাশিয়ার জন্য সুবিধাই হয়েছে।

কীভাবে পুতিন রুশ প্রভাব পুনঃ-প্রতিষ্ঠিত করতে পারছেন?

প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়া রুশদের জন্য একটি ঐতিহাসিক ট্রাজেডি। বিশ্বে রাশিয়ার প্রভাব পুনঃ-প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মরিয়া। সিরিয়াকে তিনি সেই লক্ষ্য অর্জনে অন্যতম একটি সিঁড়ি হিসাবে দেখছেন।

সিরিয়া থেকে পুতিন এখন লিবিয়াতেও হাত বাড়িয়েছেন। সেখানে জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারের বিরোধী মিলিশিয়া নেতা জে. হাফতারকে সমর্থন দিচ্ছেন তিনি।

ভেনিজুয়েলার সরকার যাতে টিকে যায়, তার জন্য রাশিয়া সবরকম সহযোগিতা দিতে শুরু করেছে

কিন্তু রাশিয়াকে ঠেকাতে কি করতে পারে পশ্চিমারা?

জনাথন মার্কাস মনে করেন, সমস্যা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বে এখন নেতৃত্বের একটি শূন্যতা চলছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ নেই। রাশিয়াকে এক নম্বর শত্রু ভাবতে তিনি রাজী নন।

জার্মানি তাদের নিজেদের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে ব্যস্ত। ব্রিটেন বছরের পর বছর ব্রেক্সিট সঙ্কটে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বাকি রয়েছে ফ্রান্স।

এ সপ্তাহের লন্ডনে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর রুশ বিষয়ক দূত পিয়ের ভিঁম'র সাথে কথা হয় জনাথন মার্কাসের। ফরাসী ঐ কূটনীতিক পরিষ্কার ইঙ্গিত দেন বৈরিতার পথ ছেড়ে ফ্রান্স রাশিয়ার সাথে একটি আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী।

ফ্রান্স অবশ্য বলছে তারা রাশিয়াকে কোনো ছাড় দিতে চায়না। ক্রাইমিয়া দখলের পর যে নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার ওপর চাপানো হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে, তবে একইসাথে মস্কোর সাথে একটি সংলাপের রাস্তা খোলা রাখতে হবে।

তবে, জনাথন মার্কাস বলছেন, অনেক পশ্চিমা কূটনীতিক ফরাসী প্রেসিডেন্টের এই নীততে ভরসা রাখতে পারছেন না।

তাদের কথা - যে দেশটি পশ্চিমা দেশগুলোর পশ্চিমা দেশগুলোর নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করছে, বাইরের দেশে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করছে, অব্যাহত-ভাবে পশ্চিমা স্বার্থে সাইবার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের সাথে আস্থা তৈরির চেষ্টা অর্থহীন ।

পশ্চিমারা রাশিয়ার ব্যাপারে কৌশল নিয়ে কালক্ষেপণ করতে পারে।

কিন্তু তুরস্কের সেই সময় নেই। পচিমাদের নিয়েও তিনি ভরসা হারিয়েছেন। ফলে পুতিনের সাথে কথা বলা ছাড়া এরদাগানের কাছে কাছে এই মুহূর্তে অন্য কোনো রাস্তা নেই।