মসজিদে হামলার পর সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল নিউজিল্যান্ড
মসজিদে হামলার পর সহমর্মিতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করল নিউজিল্যান্ড
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আরটিএনএন
ওয়েলিংটন: ‘নিউজিল্যান্ড আপনাদের সাথে শোক প্রকাশ করছে। আমরা আপনাদের সাথেই আছি।’
চলতি মাসের গত ১৫ তারিখ শুক্রবার জুমার সালাত আদায় করতে আসা মুসলিমদের উপর ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য হামলা চালিয়ে ৫০ জন মুসলিমকে হত্যা করার পরের সপ্তাহে জুমার সালাত আদায় করার জন্য ঠিক একই মসজিদে অর্থাৎ নিউজিল্যান্ডের আল-নূর মসজিদ হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছিলেন।
আর উপস্থিত সমবেত জনতার সামনে উপরোল্লিখিত মন্তব্য করেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডেন।
হামলার ঠিক পরে দেয়া এক বিবৃতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডেন ঠিক একই রকমের মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘হামলার শিকার হওয়াদের মধ্যে অনেক অভিবাসী এবং উদ্বাস্তু রয়েছেন। তারা আমাদের অংশ। কু কর্মকারী আমাদের কেউ নয়।’
হামলার পর নিউজিল্যান্ডের হাজার হাজার নাগরিকও ঠিক একই ধরনের আবেগ পোষণ করছে। এটি এমন একটি আবেগ যা হামলাকারীর বিভক্ত করণ এবং ঘৃণার আদর্শের চাইতে হাজার গুণ বেশী শক্তিশালী।
নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা তাদের মুসলিম প্রতিবেশীদের সমর্থন এবং আলিঙ্গনের মাধ্যমে সান্ত্বনা জানানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
চলতি মাসের ২২ তারিখ শুক্রবার আল-নূর মসজিদে মুসলিমদের সাথে একাত্ম প্রকাশ করতে এসে দেশটির প্রেসিডেন্ট জাসিন্ডা আর্ডেন বলেন, ‘নবী মুহাম্মদ(সা.) বলেছেন, ‘দয়া, ধৈর্য এবং সহানুভূতির মাধ্যমে বিশ্বাসীরা এমনভাবে এক হয় যেন তারা সবাই একই শরীরের অংশ।’
তিনি বলেন, ‘যখন শরীরের কোনো অংশ কষ্ট পায় তখন পুরো শরীর এর যন্ত্রণায় ভুগে থাকে।’
এসময় সেখানে হাজার হাজার অমুসলিম নাগরিক এসেছিলেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন বয়সের নারী, পুলিশ অফিসার, টেলিভিশন উপস্থাপক থেকে সাধারণ নাগরিকদের উপস্থিতি ছিল।
একই সাথে দেশের বিভিন্ন মসজিদের বাহিরে অবস্থান করে নিউজিল্যান্ডের নারীরা মুসলিমদের সাথে একাত্ম ঘোষণা করার জন্য হিজাব পরিধান করেন।
এর পূর্বে জুমার সালাতের জন্য দেয়া আজান নিউজিল্যান্ডের জাতীয় রেডিও এবং টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয় এবং পুরো দেশজুড়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
হামলার শিকার মুসলিমদের সম্মান জানানোর জন্য পুরো নিউজিল্যান্ড ব্যাপী দেশটির ঐতিহ্যবাহী মাউরি ড্যান্স যা ‘হাকা’ নামে পরিচিত তা প্রদর্শিত হয়।
প্রসঙ্গত, মাউরিরা নিউজিল্যান্ডে অন্যতম আদিবাসী এবং তাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য দেশটির জাতীয় সংস্কৃতি আর পরিচয়ের অন্যতম ধারক বাহক।
নিউজিল্যান্ডের জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ মানুষ মুসলিম আর দেশটির এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সংহতি প্রকাশ করতেই পুরো দেশ জুড়ে এমন সব আয়োজন করা হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের ইমাম ফাউদা যিনি গত শুক্রবারের জুমার সালাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি বলেন, ‘আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে গিয়েছে কিন্তু আমরা ভেঙ্গে পড়িনি। আমরা এখনো জীবিত আছি, আমরা একসাথে অবস্থান করছি, কেউ যাতে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করতে পারে এজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্য তিনি একই সাথে দেশটির প্রধানমন্ত্রী আর্ডেনের প্রশংসা করে একে ‘বিশ্ব নেতৃত্বের জন্য একটি উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার সমূহের সাথে অবস্থান করায় আপনাকে ধন্যবাদ এবং একটি সাধারণ স্কার্ফের মাধ্যমে আমাদের সম্মানিত করার জন্য আপনাকে আমরা অভিবাদন জানাই।’
নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা একটি পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে: তুমি আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে পার নি
হামলাকারী মসজিদে হামলার পূর্বে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘The Great Replacement’ নামের ৭৪ পৃষ্ঠার একটি ইশতেহার প্রকাশ করে।
তার ইশতেহারে বিতর্কিত ফরাসি দার্শনিক রেনাউদ কামুসের একটি উক্তি পরিষ্কার ভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। রেনাউদ কামুস একবার মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘মুসলিম দেশসমূহ থেকে অতি মাত্রায় অভিবাসী প্রবেশ করে ইউরোপের সমাজ এবং পরিচয়ের জন্য ঝুঁকি তৈরী করছে।’ কামুস এটাকে ‘Great Replacement’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।
আর ‘The Great Replacement’ নামের এই ধারণা উগ্র শ্বেতাঙ্গ বাদীদের আদর্শের মূলে অবস্থান করে। এই একই ধরণের আদর্শ লালন করে নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলা কারী সন্ত্রাসী।
হামলাকারী সন্ত্রাসীর ইশতেহারে বলা হয়- ‘অতি মাত্রায় অভিবাসনের ঝুঁকি ইউরোপের মানুষদের বিরুদ্ধে একধরনের অপরাধ। এটি যদি প্রতিহত করা না যায় তবে চূড়ান্ত ফলাফল সরূপ ইউরোপের জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি এবং বর্ণের মধ্যে পুরো পুরি প্রতিস্থাপন ঘটবে।’
হামলাকারীর পরিষ্কার ভাবে বোঝাতে চেয়েছে যে, তার হামলার লক্ষ মূলত নিউজিল্যান্ডের মুসলিম সমাজ যাদের অনেকেই দেশটিতে অভিবাসী হিসেবে এসেছিল।
হামলাকারী লিখেছিল- ‘আমাদের অনেকেই আগ্রাসন কারীদের এ বিষয়টি দেখাতে চায় যে, আমাদের ভূমি তাদের ভূমি নয়। আমাদের মাতৃভূমি শুধুমাত্র আমাদের। যতক্ষণ অবধি একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ জীবিত রয়েছে তারা আমাদের ভূমি জয় করতে পারবে না এবং তারা আমাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিস্থাপিত হতে পারবে না।’
হামলাকারীর বার্তাটি ছিল ভয়াবহ ঘৃণা দ্বারা আক্রান্ত। মুসলিম জনগোষ্ঠী নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ আর হামলাকারীর দেশ অস্ট্রেলিয়ায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২.৬ শতাংশ।
তথাপি তথাকথিত আসন্ন ‘সাংস্কৃতিক প্রতিস্থাপন’ এর মিথ এখনো সমাজে বিদ্যমান এবং তা হামলাকারী যে আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিমদের হত্যা করেছে তার মতই তা শক্তিশালী ভাবে অনেকের মনে বিরাজ করছে বলে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
কিন্তু নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা তাদের ঐক্যের শক্তির মাধ্যমে এসব মিথকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছে
নিউজিল্যান্ডের শিক্ষার্থীরা তাদের মোটর বাইক প্রদর্শনীর মাধ্যমে এবং স্থানীয় আদিবাসী মাউরি জনগোষ্ঠী তাদের ‘হাকা’ নাচের মাধ্যমে, দেশটির পুলিশ অফিসারেরা এবং টেলিভিশন উপস্থাপিকা বৃন্দ হিজাব পরিধান করে সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে একই সাথে দেশটির সাধারণ নাগরিক বৃন্দ দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মসজিদ সমূহে এসে যেভাবে হামলার শিকার মুসলিম সমাজের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছে তাতে একটি পরিষ্কার বার্তা রয়েছে: ‘আমাদের সমাজে বসবাসরত মুসলিম গণ আগ্রাসন কারী নয়। তারা একই সাথে কোনো কিছুর প্রতিস্থাপন কারী ও নয়।’
তারা নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী। তারা আমাদের অংশ
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের অধিবাসী ৫২ বছর বয়সী অমুসলিম নারী বেল সিবলি যিনি নিহত মুসলিমদের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য স্কার্ফ পরিধান করেছেন তিনি গত শুক্রবার বার্তা সংস্থা এনডিটিভি কে বলেন, ‘হামলাকারী আমাদের বিভক্ত করতে পারিনি বরং আমরা আলিঙ্গন বদ্ধ হয়েছি।’
সূত্র: ভক্স ডট কম।