মুসলিমদের প্রতি সংহতি প্রকাশে নারীদের হিজাব পরিধান, কিছু বুদ্ধিজীবীর গাত্রদাহ


আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আরটিএনএন

ওয়েলিংটন: চলতি মাসের ১৫ তারিখ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ৫০ জন মুসলিমের হত্যাকাণ্ডের পর নিহতদের স্মরণে দেশটির নারীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং রাজপথে হিজাব পরিধান করেন।

ইসলামভীতি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চালানো এই হামলায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে মুসলিম নারীদের পরিহিত হিজাবের আদলে নিউজিল্যান্ডের অমুসলিম নারীরা তাদের মাথা ঢেকে রাখেন।

হামলাকারী ২৮ বছর বয়সী একজন খ্রিষ্টান অস্ট্রেলীয় নাগরিক যাকে হামলার পর পরই গ্রেপ্তার করা হয়। হামলার পূর্বে সে ইন্টারনেটে ৭৩ পৃষ্ঠার একটি ইশতেহার প্রকাশ করে যেখানে হামলাকারী নিজেকে মুসলিম বিরোধী এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেতাঙ্গ বাদী আন্দোলনের সমর্থক বলে দাবী করে।

নিউজিল্যান্ডের নারীদের হিজাব পরিধান করার পেছনে সামাজিক মাধ্যমের দুটি উদ্যোগ কাজ করে এর একটি হচ্ছে- ‘Scarves in Solidarity’ এবং অন্যটি ‘Headscarf for Harmony’।

দেশটির অনেক সংবাদ পাঠিকা খবর পাঠের সময় হিজাব পরিধান করে ক্যামরার সামনে আসেন এবং তারা ইসলামিক সম্ভাষণ পদ্ধতিতে ‘সালাম’ দিয়ে খবর পাঠ শুরু করেন।

নিউজিল্যান্ডের নারীদের হিজাব পরিধানের অন্যতম উদ্যোক্তা অকল্যান্ডের অধিবাসী থাইয়া আশমান। ক্রাইস্টচার্চে হামলার পর মুসলিম নারীরা তাদের হিজাব পরিধান করে বাহিরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন এমন খবর শুনে তিনি বলেন, ‘আমরা আপনাদের সাথেই রয়েছি। আমরা চাই আপনি এ দেশের রাজপথকে আপনার নিজের বাড়ির মতই মনে করুন। আমরা আপনাদের ভালোবাসি, সমর্থন করি এবং সম্মান করি।’

তবে হিজাব পরিধান করার উদ্যোগটি যে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য হয়েছে তা নয়। অনেক ঘৃণ্য ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় এ উদ্যোগের বিরোধিতা এবং সমালোচনা করেছেন।

অনেকের মতে ইসলামিক দেশসমূহে মুসলিম নারীরা যে হিজাব পরিধান করে তা মূলত নারীর প্রতি বৈষম্যের একটি প্রতীক।

তথাকথিত নারীবাদী তাসলিমা নাসরিন হিজাবের সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য আমার হিজাব পরিধান করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যেসকল মানুষ নিজেদেরকে শুধুমাত্র একজন মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে চায় তারা সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হিজাব পরিধান করে।’

কানাডার মানবাধিকার কর্মী ইয়াসমিন মোহাম্মদ এক টুইটার বার্তায় বলেন, এমনকি যেখানে অনেক ইসলামিক দেশ হিজাবের বিরুদ্ধে লড়াই করছে সেখানে পশ্চিমারা এর প্রতি ‘বস্তু কামে’ আসক্ত হয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের টিভি উপস্থাপিকাদের হিজাব পরিধান করার সমালোচনা করেন সাংবাদিক রাগু কামাদ বলেন, ‘সাংবাদিকরা তাদের পোশাকের পরিবর্তনের মাধ্যমে সংহতি জানাচ্ছে কিন্তু তারা এর মাধ্যমে সহযোগিতা করতে পারছে না।’

এদিকে ভারতেও নিউজিল্যান্ডের অমুসলিম নারীদের হিজাব পরিধান করার কারণে বিতর্ক ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। দেশটির একজন টুইটার ব্যবহারকারী বলেন, ভারতীয়রা আশা করে যে মুসলিমরা হিন্দুদের উৎসব সমূহে অংশ গ্রহণ করবে কিন্তু নিউজিল্যান্ড যেভাবে ইসলামের ঐতিহ্যের চর্চা করে সংহতি জানাচ্ছে তা ভারতে হতে দেয়া যাবে না।

অন্যদিকে ভারতের রাজনৈতিক কর্মী গীতা শাগেল, সাংবাদিক সালিল ত্রিপাথি এবং নৃতাত্ত্বিক আনু জালাইয়াসের মধ্যে এ বিষয় নিয়ে তীব্র বিতর্ক হতে দেখা যায়।

এই তিন জন ব্যক্তি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর হিজাব পরিধান করার বিষয়ে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন।

যেখানে আনু জালাইয়াস জাসিন্ডা আর্ডেনের হিজাব পরিধান করার সিদ্ধান্তকে ‘একটি সাহসী পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন সেখানে সালিল ত্রিপাথি বলেন, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসী হামলার পরে যেভাবে সবকিছু সামলে নিয়েছেন তা প্রশংসার যোগ্য কিন্তু তিনি হিজাব নিয়ে রাজনীতি করছেন।

নিউজিল্যান্ডের নারীদের হিজাব পরিধান করার কারণে দেশটির মুসলিম নারীরা নিজেদেরকে পর্দার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখার দাবীর বৈধতা দেয়া হয়েছে বলে গীতা শাগেল মন্তব্য করেন।

নিউজিল্যান্ডের অধিবাসীরা বিভিন্ন ভাবে মসজিদে হামলা চালিয়ে মুসলিমদের হত্যার নিন্দা জানিয়েছে আর মাথা ঢেকে রেখে নিন্দা জানিয়ে তারা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।

গত ২২ মার্চ শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদের পাশে অবস্থিত একটি পার্কে নিহতদের স্মরণে অনুষ্ঠিত এক শোক সভায় হাজারো নিউজিল্যান্ডবাসী অংশ নিয়েছেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডেন নিজে ওই শোক সভায় অংশ নিয়েছিলেন এবং উপস্থিত লোকদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন।

এছাড়াও মুসলিমদের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে স্থানীয় সময় ১.৩০ ঘটিকার সময় গত শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের টেলিভিশন এবং রেডিও চ্যালেন সমূহে সালাতের আহ্বান অর্থাৎ আজান প্রচার করা হয়। এর পূর্বে পুরো নিউজিল্যান্ড জুড়ে দুই মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

একই সাথে হত্যাকাণ্ডের শিকার মুসলিমদের সম্মানে নিউজিল্যান্ডের মাউরি অধিবাসীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী হাকা নৃত্যের মাধ্যমে মুসলিমদের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করে।

২৯ মার্চ শুক্রবারও জাতীয়ভাবে ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদের পাশে অবস্থিত একটি পার্কে নিহতদের স্মরণে অনুষ্ঠিত এক শোক সভায় লাখো নিউজিল্যান্ডবাসী অংশ নেন।

হামলার পর পরই দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডেন এই ঘৃণ্য হামলাকে ‘স্মরণ কালের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা’ বলে অভিহিত করেন এবং একে সন্ত্রাসী হামলা বলে উল্লেখ করেন।

নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত মুসলিম অভিবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তারা যেন এ দেশকে নিজেদের দেশ বলেই মনে করেন। তিনি একই সাথে দেশটির অস্ত্র আইনের সংশোধনের ঘোষণা দেন এবং তাৎক্ষণিক ভাবে সেমি অটোমেটিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করেন।

সূত্র: scroll.in