সীমা অতিক্রম করলে দ্রুত কঠোর পরিণতি: পশ্চিমা বিশ্বকে পুতিনের হুশিয়ারি


আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আরটিএনএন

মস্কো: ভ্লাদিমির পুতিন এমনিতে স্বল্পভাষী। জনসমক্ষে বাগাড়ম্বর করা বা হুমকি-ধমকি দেওয়ার লোক তিনি নন। কিন্তু বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া তার এক ভাষণে যে ভাষায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের শাসিয়েছেন, তার নজির বিরল।

ধারণা করা হচ্ছিল বাৎসরিক ওই ভাষণে পুতিন অর্থনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কোভিড নিয়েই কথা বলবেন। কিন্তু ৮০ মিনিটের ভাষণের এক পর্যায়ে অনেকটা সময় ধরে তার ধারালো আক্রমণের নিশানা হয়ে ওঠে প্রতিপক্ষ পশ্চিমা দেশগুলো। খবর বিবিসি বাংলার

তিনি হুঁশিয়ার করেন এই বলে যে রাশিয়ার সাথে আচরণে কেউ যদি রেড-লাইন অর্থাৎ সীমা অতিক্রম করে, তাহলে তাকে দ্রুত এবং কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হবে।

এই হুঁশিয়ারি তিনি এমন সময় দিলেন যখন ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ এবং বিরোধী নেতা আলেস্কেই নাভালনিকে আটক করা নিয়ে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়ার তীব্র সমালোচনায় লিপ্ত।

জো বাইডেন রাশিয়ার ওপর নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছেন। তার আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এক সাক্ষাৎকারে পুতিনকে একজন ‘খুনী‘ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন, যা নিয়ে ভীষণ ক্ষেপেছে ক্রেমলিন।

প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার পেছনে হন্যে হয়ে লেগেছে। তিনি বলেন, রাশিয়া এবং দুই সাবেক সোভিয়েত প্রতিবেশী ইউক্রেন এবং বেলারুশের স্থিতিশীলতা হুমকিতে ফেলার চেষ্টা চলছে।

তিনি বলেন, অন্যায় নিষেধাজ্ঞার সাথে যোগ হয়েছে আরেকটি বিপজ্জনক বিষয় - বেলারুশে অভ্যুত্থানের চেষ্টা।

গত ১৭ই এপ্রিল বেলারুশের সরকার জানায় যে তারা আমেরিকার যোগসাজশে প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোকে হত্যার একটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। রুশ গুপ্তচর সংস্থা এফএসবি জানিয়েছে, তারা এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত দুজনকে আটক করেছে।

গত বছর বিতর্কিত একটি নির্বাচন নিয়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোর সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে রাশিয়া। বৃহস্পতিবার দুই দেশের নেতার মধ্যে একটি বৈঠকের কথা রয়েছে। বোঝাই যায়, বেলারুশে কথিত এই অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের ঘটনায় ক্ষিপ্ত পুতিন।

রুডওয়ার্ড কিপলিংয়ের বিখ্যাত বই দ্য জঙ্গল বুকের কাহিনী উদ্ধৃত করে রাশান প্রেসিডেন্ট বলেন শের খান নামের বাঘকে যেমন তুষ্ট করতো কিছু শেয়াল, তেমনিভাবে কিছু পশ্চিমা দেশ আমেরিকাকে তুষ্ট করতে ব্যস্ত।

আমরা অশান্তি চাই না, সেতু পুড়িয়ে দিতে চাই না। কিন্তু আমাদের বদান্যতাকে কেউ যদি দুর্বলতা মনে করে, ‘রেড লাইন‘ অতিক্রম করে, তখন আমাদের জবাব হবে দ্রুত এবং তীব্র। আমরা তখন সীমা-পরিসীমা বা অনুপাতের ধার ধারবো না।

রাশিয়ার বেঁধে দেওয়া সেই রেড লাইন ব্যাখ্যা করেননি পুতিন। তিনি বলেন, ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রাশিয়া সেটি বিবেচনা করবে।

তার ভাষণে পুতিন বলেন, ময়দানে (ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রীয় চত্বর) যখন ঘটনা ঘটছিল, বেলারুশ বা ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমারা তখন তার পরিণতি নিয়ে ভাবেনি।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে কিয়েভের ময়দান চত্বরে গণবিক্ষোভের মাঝে ইউক্রেনের রুশ সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়োনুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। পরের মাসেই রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া অঞ্চলটি দখল করে নেয়। দেশের জাতিগত রুশ অধ্যুষিত অঞ্চলে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।

পুতিন হুঁশিয়ার করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে উসকানিদাতারা এমন পরিণতি ভোগ করবে, যে অভিজ্ঞতা আগে তাদের কখনও হয়নি।

রেড লাইনের আওতা

রেড লাইন বলতে প্রেসিডেন্ট পুতিন কী বুঝিয়েছেন, সে সম্পর্কে পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, বাইরের দেশে আমাদের নিরাপত্তা স্বার্থ, আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় নাক গলানো - সেটা নির্বাচন হোক বা অন্য কোন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হোক।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর থেকেই মস্কোর মধ্যে এই সন্দেহ-ভীতি দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে যে আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা রাশিয়াকে চিরতরে দুর্বল করে দেওয়ার কৌশল নিয়ে এগিয়ে চলেছে।

বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ এবং সাবেক সোভিয়েত কিছু রাষ্ট্রে নেটো সামরিক জোটের প্রসারকে রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করে।

রুশ বিশেষজ্ঞ কির জাইলস তার গবেষণা গ্রন্থ ‘মস্কো রুলস: হোয়াট ড্রাইভস রাশিয়া টু কনফ্রন্ট ওয়েস্ট‘ বইতে লিখেছেন: পুতিনের পশ্চিমা স্বার্থবিরোধী তৎপরতা, বক্তব্য-বিবৃতির মূলে রয়েছে নিরাপত্তা নিয়ে রাশিয়ার অব্যাহত উদ্বেগ।

তার মতে, মস্কোর এই উদ্বেগের পেছনে প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করেছে পূর্ব ইউরোপে নেটো জোটের প্রসার, এবং নেটো সৈন্য ও অস্ত্র মোতায়েন।

সম্প্রতি লন্ডনের গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজে রাশিয়া নিয়ে এক প্রশ্নোত্তরের সময় জাইলস বলেন, রাশিয়া কেন এসব করছে, তারা কী চায়, এটা নিয়ে পশ্চিমে অনেক অস্বচ্ছতা রয়েছে। আমি বলবো, রাশিয়া ১৯১৪ সালে যা চাইতো এখনও সেটাই চায়। তারা বৃহৎ একটি শক্তি হতে চায়, সেই মর্যাদা চায়, সেই প্রভাব চায় এবং এর প্রতি তারা বাকি বিশ্বের স্বীকৃতি চায়।

জাইলস বলেন, রাশিয়া চায় আশপাশের দেশগুলোর ওপর যেন তাদের কর্তৃত্ব থাকে, দেশগুলো যেন তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকে। সে কারণে দোরগোড়ার দেশগুলোতে নেটো জোটের সামরিক উপস্থিতিকে রাশিয়া চরম হুমকি হিসাবে বিবেচনা করছে।

এই উদ্বেগের সূচনা হয় ১৯৯৯ সালে, যখন রাশিয়ার তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে নেটো জোট কসোভোতে দিনের পর দিন বিমান হামলা চালিয়ে রাশিয়ার মিত্র দেশ সার্বিয়ার কাছে থেকে ওই প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি গোপন এক রিপোর্টে - যেটি পরে জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় - বলা হয় যে কসোভোতে নেটো অভিযানের পরিণতিতে রাশিয়া তাদের সামরিক কৌশলের নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়।

গবেষক স্টিভেন জে. ব্ল্যাংক তার ওই গবেষণা রিপোর্টে রুশ এক সিনিয়র সাংবাদিককে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, রুশ জেনারেলরা আমাকে বলেছেন রাশিয়ায় এখন বিল ক্লিনটনের একটি ভাস্কর্য তৈরি প্রয়োজন, কারণ কসোভোর যুদ্ধ রাশিয়ার রাজনীতি আমূল বদলে দিয়েছে। রাশিয়াকে সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, এ নিয়ে আর কেউই কোনও বিরোধিতা এখন আর করবে না।

স্টিভেন ব্ল্যাংক লেখেন: ইরাকে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের সামরিক অভিযান (প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ) নিয়ে যে ভীতি রাশিয়ার মধ্যে তৈরি হয়, কসোভোতে নেটোর অভিযানে সেই উদ্বেগ আরও পোক্ত হয়। কসোভো যুদ্ধের পর রাশিয়া দেখলো যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর নিরাপত্তা নিয়ে যে ভীতির জন্ম হয়েছিল, তা এখন বাস্তব।

রাশিয়ার মধ্যে ভয় ঢোকে যে আশপাশের দেশগুলোতে রাজনৈতিক সঙ্কট জাতিগত বিরোধকে যুক্তি হিসাবে দেখিয়ে নেটো এখন একইভাবে সেসব জায়গায় ঢুকতে পারে। এমনকি রাশিয়ার ভেতরেও নেটো টার্গেট করতে পারে এমন আতঙ্কও তৈরি হয়, কারণ চেচনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে তখন খুবই শোরগোল তুলেছিল আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলো।

ব্ল্যাংক আরও লেখেন, নেটো জোট রাশিয়ার সাথে সহযোগিতা করার যে বোঝাপড়া করেছিল, কসোভোতে হস্তক্ষেপ করে তা ভাঙ্গা হয়। পরে রাশিয়ার উদ্বেগের তোয়াক্কা না করে একে একে শুরু হয় পূর্ব ইউরোপে নেটোর সম্প্রসারণ। এমনকি রাশিয়ার লাগোয়া তিনটি ক্ষুদ্র সাবেক সোভিয়েত বাল্টিক দেশকেও (লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া এবং এস্তোনিয়া) নেটোর অংশ করা হয়।

ফলে, অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার মানসিকতা পেয়ে বসে রাশিয়ার ভেতর। জর্জিয়ায় রুশ সামরিক অভিযান এবং ইউক্রেনের গৃহযুদ্ধে রুশ উসকানি ও ক্রাইমিয়া দখলের বিষয়গুলো সম্পর্কে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে ওগুলো ছিল ওই দুই দেশকে পশ্চিমা সামরিক এবং অর্থনৈতিক বলয় থেকে দূরে রাখার প্রয়াস।

রাশিয়া বার্তা দেওয়া চেষ্টা করে - আর সহ্য করা হবে না।

‘মস্কো রুলস‘ বইয়ের লেখক কির জাইলস বলেন, অবরুদ্ধ হয়ে পড়ার এই মানসিকতা থেকেই গত এক দশকে রাশিয়া তার সামরিক শক্তি বহুগুণে বাড়িয়েছে এবং অস্ত্র-সম্ভারের আধুনিকীকরণ করেছে। সন্দেহ নেই যে তারা সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সাবেক রুশ সেনা প্রধান ইউরি বালুয়েভস্কিকে উদ্ধৃত করে জাইলস বলেন, এটা এখন অবধারিত সত্য যে একটি যুদ্ধ আসন্ন।

পশ্চিমাদের অনেকের মধ্যে একটি ধারনা রয়েছে যে মূল সমস্যা হচ্ছে পুতিন এবং তার স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা।

পশ্চিমা পত্র-পত্রিকায় বা ভাষ্যে, কিংবা পশ্চিমা রাজনীতিকদের মন্তব্যে হরহামেশা শোনা যায় যে রাশিয়ার ‘নতুন জার‘ হিসাবে দেখা দিয়েছেন পুতিন। তিনি বাস্তবতার ধার ধারেন না, বরং ভিন্ন এক জগতে বসবাস করেন। রাশিয়ার ভেতরেও তাকে নিয়ে এমন সমালোচনা আছে।

কিন্তু কির জাইলস মনে করেন, এই ধারণা ভুল।

রাশিয়া রাষ্ট্র হিসাবে তাদের স্বার্থ রক্ষায়, মর্যাদা এবং প্রভাব পুনরুদ্ধারের যে নীতি নিয়েছে, পুতিন সেটাই অনুসরণ করছেন। তিনি আরও বলেন, পশ্চিমা শক্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি একসময় তারা হারিয়ে বসেছিল, কিন্তু সেই শক্তি তাদের হাতে অনেকটাই ফিরে এসেছে। ধীরে ধীরে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা এখন কীভাবে সাড়া দেবে? তারা কোন পথ নেবে?

সোভিয়েত আমলের মত আশেপাশের দেশগুলোতে প্রভাববলয় পুনর্বহাল কি রাশিয়ার পক্ষে আর কখনও সম্ভব? বিরোধ এড়াতে পশ্চিমারা কি সেই আপোষ করবে? প্রায় অসম্ভব। কারণ, প্রথমত সাবেক সোভিয়েত বলয়ের সেসব দেশের সিংহভাগ মানুষই হয়তো এখন তা মেনে নেবে না।

জাইলস সেসব দেশের অধিকাংশ মানুষ তা যেমন মানবে না, তেমনি এটি একটি নৈতিকতার প্রশ্নও। কোনও দেশের স্বার্বভৗম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে পশ্চিমারা আপোষ করবে না। সার্বভৌমত্বের যুক্তি দেখিয়েই নেটো জোট রাশিয়ার সীমান্তেও হাজির হয়েছে। কিন্তু এটিও সত্য যে তার সম্ভাব্য পরিণতিকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

জাইলস বলেন, আর মন্তব্য করেন, রাশিয়া পুরো কেক চায় না, অর্ধেকেই সন্তুষ্ট থাকবে, কিন্তু বড় কোনও বিপদ এড়াতে ভাগাভাগির সেই সূত্র এখনও দু'পক্ষের কাছে অজানা।