ভারতীয় ছাত্ররা কেন যুদ্ধের মধ্যেই ইউক্রেনে ফিরে যাচ্ছে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আরটিএনএন
ঢাকা: যুদ্ধের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা নিয়েই ঋষি দ্বিভেদী গত শরৎকালে ইউক্রেণে ফিরে গেছেন মেডিক্যাল পড়তে। ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলার আগেই সাইরেন বাজিয় সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে আমাদের। দিনে অন্তত চার বার এরকম ভাবে সাইরেন বাজাচ্ছে।
মেডিক্যালে পঞ্চম বর্ষের ওই ছাত্র উত্তরপ্রদেশের কনৌজ শহরের আদি বাসিন্দা। ইউক্রেনের লাভিভ জাতীয় চিকিৎসাবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন এবং সার্জারিতে স্নাতক কোর্স করছেন তিনি।
তার মতো আর কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল রাশিয়া হামলা শুরু করার মুখেই। কিন্তু তিনি গত অক্টোবরে কোর্স শেষ করার জন্য ফিরে গেছেন।
ফিরে যাওয়া ছাড়া বিশেষ রাস্তা নেই
যুদ্ধের শুরুতেই ২২ বছর বয়সী এক মেডিক্যাল ছাত্র গোলার আঘাতে মারা যাওয়ার পরে ১৮ হাজার ছাত্রছাত্রী সহ মোট ২৩ হাজার ভারতীয়কে সরিয়ে আনা হয়েছিল।
কিন্তু সরকারের নির্দেশিকা উপেক্ষা করেই ওই ছাত্রছাত্রীদের অনেকে ফিরে গেছেন ইউক্রেনে। তারা বলছেন ডাক্তার হিসাবে কাজ করতে গেলে তাদের সামনে এ ছাড়া আর বিশেষ রাস্তা নেই।
দ্বিভেদীর মতো এগারোশো ছাত্র ইউক্রেনে বাস করছেন এখন। বেশিরভাগই লাভিভ, উজগোরোদ আর তেরনোপিলের মতো পশ্চিমাঞ্চলীয় শহরগুলিতে রয়েছেন। ওই অঞ্চলে রাশিয়ান বিমান হামলা হতে পারে, কিন্তু শহরগুলি থেকে পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গন অনেক দূরে।
তবে শুধু যে এই ভারতীয়রাই ইউক্রেনে ফিরে গেছেন তা নয়। বিবিসি দেখা পেয়েছে কিছু আফ্রিকান ছাত্রছাত্রীরও যারা লাভিভে রয়েছেন। অন্যরাও ভাবছেন যে তারা কী করবেন।
লাভিভ শহরে চতুর্থ বর্ষের মেডিক্যাল ছাত্রী সৃষ্টি মোজেস বলেন, আমরা জানি না যে আমাদের কোর্স শেষ করতে পারব কী না। মাথার ওপর দিয়ে যখন হেলিকপ্টার বা বিমান যাতায়াত করে, তখন আমরা ঘুমোতে পারি না। সবসময়ে চিন্তা হয় কখন বুঝি হামলা শুরু হল।
তিনি যেখানে থাকতেন, সেখানে মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ থাকত না। তাই নিয়মিত বিদ্যুৎ থাকে এরকম একটা উচ্চবিত্ত এলাকায় ফ্ল্যাট নিতে হয়েছে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় দেরাদুন শহরের মূল বাসিন্দা মোজেসকে।
কেন ফিরতে হল ইউক্রেনে?
এই পরিস্থিতিতে কেন ছাত্রছাত্রীরা ইউক্রেনে ফিরে গেলেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে পড়াশোনা করে এমন বেশিরভাগ মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীই স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসতে চান। কিন্তু তার জন্য জাতীয় মেডিক্যাল কমিশনের কাছ থেকে তাদের অনুমতিত নিতে হয়। ওই কমিশনই ভারতে মেডিক্যাল শিক্ষা নিয়ন্ত্রন করে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে যখন বাধ্য হয়ে এই ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা বন্ধ করে চলে এল, তখন ভারতের শিক্ষা মন্ত্রী বলেছিলেন যে “তাদের চিকিৎসক করে তোলার জন্য যা যা দরকার তা করা হবে।
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন ভারতের কলেজগুলিতে এদের ভর্তি করে নিতে অনুরোধ করেছিল, রাজ্য সরকারগুলিও একই আবেদন করেছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক এই অনুরোধও করেছিল যে ‘এককালীন ব্যবস্থা হিসাবে ফিরে আসা ছাত্রছাত্রীদের যেন ভারতের বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।‘
কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রক একদম বিপরীত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জুলাই মাসে জানিয়ে দেয় যে বিদেশের মেডিক্যাল কলেজ থেকে ভারতীয় মেডিক্যাল কলেজে বদলি নিয়ে আসার কোনও নিয়ম নেই।
আবার ইউক্রেন থেকে ফিরে আসা অনেক ছাত্রছাত্রী ভারতের মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতেও চান নি। ভারতে ভর্তি হওয়ার জন্য এক তো কঠিন প্রতিযোগিতা আছে আর খরচও খুব বেশি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সিদ্ধান্তের ফলে ফিরতে হল ছাত্রদের
তেরনোপিল জাতীয় মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বৈশালী সেঠিয়া ইউক্রেন থেকে হাঙ্গেরি হয়ে চলে এসেছিলেন গত বছর মার্চ মাসে। তিনি নভেম্বরে ফিরে গেছেন।
দিল্লি লাগোয়া গাজিয়াবাদের বাসিন্দা মিজ সেঠিয়া বলেন, জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল নির্দেশ দিয়েছে যে ২০২১ সালের নভেম্বরের পরে যারা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি হয়েছেন তাদের সেইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পাশ করে আসতে হবে। এছাড়া তাদের ডিগ্রি ভারতে গ্রাহ্য হবে না।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি ইউক্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। সবাই জিজ্ঞাসা করছে যে কেন ইউক্রেনে ফিরছি। আমাদের ফিরতেই হত।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রক গত মাসে জানিয়েছিল যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ইউক্রেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত এমন ৩৯৬৪ জন ভারতীয় ছাত্রছাত্রীকে ইউক্রেনের বাইরের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রায় ১৭০ জন ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ইউক্রেনের মধ্যেই নিরাপদ জায়গায় সরে গেছে এমন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রক এটাও ঘোষণা করেছে যেসব ভারতীয় ছাত্রছাত্রী ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যে মেডিক্যাল কোর্স শেষ করেছেন, তারা বিদেশী মেডিক্যাল গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় বসতে পারবেন।
বিদেশ থেকে মেডিক্যাল পড়ে ভারতে এসে প্র্যাক্টিস শুরু করতে হলে ওই পরীক্ষায় পাশ করতে হয়।
কী করণীয় বুঝতে পারছেন না অনেকে
যেসব ছাত্রছাত্রী ইতিমধ্যেই ইউক্রেনে ফিরে গেছেন, তাদের তো থাকতেই হবে সেখানে। আর যারা যান নি এখনও, তারা বুঝে উঠতে পারছেন না যে কী করণীয় তাদের।
বিহারের বাসিন্দা দীপক কুমার ইউক্রেনে ফিরে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরিবারের চাপে তিনি যেতে পারেন নি। আমার পরিবার আপত্তি করছে কারণ তারা আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
তিনি চেষ্টা করলে ভারতের কোনও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারতেন, কিন্তু তার খরচ অত্যধিক বেশি।
এমনকি ইউক্রেনে পড়ার খরচ যোগানোর অর্থই ছিল না আমাদের কাছে। আমার বাবাকে পড়ার খরচ দিতে গিয়ে বেশ কিছু জমি বিক্রি করতে হয়েছে জানালেন দীপক কুমার।
পড়ার খরচ কম
বিবিসি যত ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলেছে, তারা জানাচ্ছেন ইউক্রেনে পুরো কোর্স শেষ করতে যা খরচ হয়, তা ভারতের কোনও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের খরচের অর্দ্ধেকেরও কম।
ইউক্রেনের লেভিভে ফিরে গেছেন, এমন এক ছাত্র শশাঙ্কের বাবা মৃত্যুঞ্জয় কুমার বলছিলেন, ভারতের বেসরকারী কলেজগুলো যেখানে ৭০ লাখ ভারতীয় টাকারও বেশি নেয়, সেখানে ইউক্রেনে লাগে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মতো।
লেভিভে বসবাসরত ঋষি দ্বিভেদী বলছেন এখন তাদের দিকে বিশেষ কেউ নজর করে না।
আমরা ফিরে আসার মাসখানেক পর অবধিও আমাদের নিয়ে চর্চা হত। কিন্তু এখন আর কেউ বিশেষ বিরক্ত করে না। কিন্তু তাদের প্রতিটা দিনই ভবিষ্যতের অনিশ্চিতার মধ্যে দিয়ে কাটে।
আমরা আমাদের অভিভাবকদের বলে দিয়েছি যে যুদ্ধ যদি আবার বেশি শুরু হয় আর আমাদের পালাতে হয়, তাহলে আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা করে নেব। কাছাকাছি সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নেব।