পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব: সময়ের সাথে কতটা বদলেছে?


নিউজ ডেস্ক

আরটিএনএন

ঢাকা: পুরান ঢাকার লালবাগ কুঠির দিকে যখন যাচ্ছিলাম তখনই পাওয়া যাচ্ছিল উৎসবের একটা আমেজ।

প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছাদ সাজানো, গান বাজছে আর আকাশে ওড়ছে ঘুড়ি। কে কার ঘুড়ি কাটতে পেরেছে সেই প্রতিযোগিতা আর ঘুড়ি কেটে ফেলার আনন্দ আর চিৎকারও ভেসে আসছিল। প্রতিবেদন বিবিসির।

একটা বাড়ির ছাদে উঠেই দেখি এক তরুণ ঘুড়ি উড়াচ্ছে আর ‘বাকাট্টা..বাকাট্টা..ধর ধর..’ বলে চিৎকার করছে।

ঘুড়ি উড়ানোর পাশাপাশি বেশিরভাগ বাড়ির ছাদেই ছিল গানবাজনার আয়োজন, লাইটিং করা।

তবে ঘুড়ি উড়ানোর মতো মানুষ কমই চোখে পড়েছে । প্রত্যেকেই তখন অপেক্ষা করছিলেন সন্ধ্যার আতশবাজি ও আগুন খেলার জন্য।

পৌষ সংক্রান্তি যেভাবে সাকরাইন উৎসব

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই সাকরাইন উৎসবকে পৌষ সংক্রান্তি বা ঘুড়ি উৎসব বলেও বর্ণনা করা হয়।

পঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনে এই সাকরাইন উৎসব আয়োজন করা হয়।

তবে বাংলা ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকা তারিখের সঙ্গে কিছুটা পার্থক্যের কারণে প্রতিবছর দুদিনব্যাপী এই উৎসবটি পালন করেন পুরান ঢাকা বাসিন্দারা।

এই উৎসবটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হলেও বহু বছর ধরে পুরান ঢাকায় সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে সাকরাইন উৎসব।

পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা আজিম বখশের ভাষায় ‘হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বলেন একে পৌষ সংক্রান্তি, আমরা ঢাকাইয়ারা বলি সাকরাইন । দুইটা একই। হিন্দুদের মধ্যে পূজার বিষয়টা আছে, মুসলমানদের মধ্যে সেটা নেই’।

এই উৎসবকে মাথায় রেখে টানা এক সপ্তাহ পুরান ঢাকার রাস্তাগুলোর অধিকাংশ গলিতে আর খোলা ছাদে হয় সুতা মাঞ্জা দেওয়ার ধুম। রোদে সুতা শুকানোর কাজও চলে পুরোদমে।

বলা যায়, সাকরাইন উৎসবে পুরান ঢাকার আকাশ থাকে ঘুড়িওয়ালাদের দখলে।

তবে সময়ের সাথে সাথে উৎসবের ধরন অনেকটা বদলে গেছে বলে অভিমত আজিম বখশের- ‘আমি ৭২ ছুঁয়েছি। ছোটবেলায় দেখেছি- আমাদের এই ফরাশগঞ্জ এলাকা ছিল বাঙালি সংস্কৃতির একটা কেন্দ্রবিন্দু। এখানে যে জমিদার বাড়িগুলো ছিল সেই বাড়িগুলোতে ঘুড়ি উৎসব হতো, তাদের নাটাইগুলো ছিল চান্দির বানানো। আর সাধারণ মানুষ বাঁশ দিয়ে বানানো নাটাই দিয়েই ঘুড়ি উড়াতো।’

‘সেইরকম ঘুড়ি উড়ানো এখন দেখি না।’

‘অনেক পরিবর্তন হয়েছে- এখন জৌলুস বেড়েছে, নানারকম জিনিস এসে ঢুকেছে। অরিজিনালটা হারিয়ে যেতে বসেছে। ঘুড়ির যে কাটাকাটির ব্যাপার সেটার জন্যতো আসলে বড় জায়গা লাগে, মাঠ লাগে।’

‘ঢাকার মানুষ এখনতো সেরকম মাঠ পায় না, তারা এখন ছাদে ছাদে ঘুড়ি উড়ায়। এখানেতো আনন্দের বিষয়টাতো এখানে কম।’

আর এখনকার তরুণ প্রজন্ম এই উৎসবের আনন্দটা ধরে রাখার জন্য পরিবর্তন নিয়ে এসেছে’- বলছিলেন আজিম বখশ, যিনি প্রাচীন ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন।

'সাকরাইন শব্দ দূষণের উৎসব'

শুধু যে পুরান ঢাকার ছেলেমেয়েরা এই উৎসবের প্রতীক্ষায় থাকে তা নয়, অন্যান্য এলাকার মানুষের মধ্যেও যে এই উৎসব নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ কাজ করে তা সাকরাইন উৎসবে গেলেই দেখতে পাওয়া যায়।

প্রতি বছর অনেক মানুষ ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব দেখতে আসেন।

এবারও দেখেছি ঢাকার বাইরে থেকে বন্ধুদের নিয়ে এই উৎসবে অংশ নিতে এসেছেন অনেক তরুণ-তরুণী। অনেকের কাছে এটা ঈদ উৎসবের মতোন।

নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা একদল তরুণ-তরুণী জানালেন উৎসবের ঘুড়ি উড়ানো থেকে শুরু করে রাতের লাইটিং, আগুন খেলা, গান-নাচ প্রতিটি বিষয়ই তাদের কাছে আনন্দের । আর এ কারণে প্রতি বছর তারা এই উৎসব দেখতে আসেন।

অনেকের কাছে এই উৎসব আনন্দের হলেও গানবাজনার শব্দে যে এটা অনেকের বিরক্তির কারণ হচ্ছে তাও বুঝতে পারা যায় মারুফ হোসেনের এই মন্তব্যে ‘সাকরাইন ভয়াবহ শব্দ দূষণের উৎসবে পরিণত হয়েছে’।

প্রতিটি বাড়ির ছাদে যে উচ্চ শব্দে গান বাজছিল -তাতে অবশ্য এ ধরনের অভিযোগ আসাটা অযৌক্তিক কিছু নয়।

সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা বিষয়টা অস্বীকার করছেন না। তবে সবকিছু মিলিয়ে যে এটা উৎসবের একটা নতুন রঙ- নতুন মাত্রা সেটাই বুঝাতে চান আয়োজকেরা।

স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য অনুযায়ী ‘ব্রিটিশ আমলের এই উৎসবটি এখন বাংলাদেশের সব মানুষ পালন করেন। পুরনো আমলে গান বাজতো মাইকে, আর এখন লাউডস্পীকারে গান বাজানো হয়। আগে আমরা খিচুড়ি করতাম এখন হয়তো কেউ বিরিয়ানি রাঁধে।’

উৎসবের কায়দা আগের মতো আছে বলেই মনে করেন তারা। অনেকে সাকরাইন উৎসবকে ঘিরে নস্টালজিকও হয়ে পড়েন। ছোটবেলার রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ানোর স্মৃতিকে বাস্তব করতেই তারা ছুটে যান পুরান ঢাকার এই ঐতিহ্যবাসী উৎসবে।

নস্টালজিক হয়ে হারুন রশিদ যেমন বলেছেন- ‘আহা। ছোটবেলায় কত ঘুড়ি উড়িয়েছি।’

সূত্র: বিবিসি।