‘লোহাখোর’ থেকে ‘বাঁশ বৈভব’: শাহীন দিল-রিয়াজের প্রামাণ্য ছবিতে জীবনের গল্প


নিউজ ডেস্ক

আরটিএনএন

ঢাকা: গত সপ্তাহে ফিনল্যান্ডের ডকপয়েন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে একটি ডকুমেন্টারি ছবি বেশ আলোড়ন তুললো। যাদের নিয়ে এই ছবি, বাংলাদেশে তাদের বলে ‘চালি’। বাঁশের ভেলায় এদের জীবন কাটে। বাঁশের ভেলার একেকটি বহরে বিশ হাজার, তিরিশ হাজার বাঁশ থাকে। খরস্রোতা নদী বেয়ে চালিরা এই বাঁশ নিয়ে যায় দূর-দূরান্তরে শহরে-বন্দরে-গঞ্জে।

উৎসবে এই ছবির চারটি প্রদর্শনীর চারটিতেই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। ছবির নির্মাতা দর্শকদের সাড়া দেখে অভিভূত।

‘বাঁশ বৈভব’ ছবিতে এমন কী আছে, যা ফিনল্যান্ডের দর্শকদের এতটা আলোড়িত করলো?

ডকুমেন্টারি ছবিটির পরিচালক শাহীন দিল-রিয়াজ বললেন, তিনি নিজেও কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন, কিন্তু পরে জানলেন ফিনল্যান্ডেও একসময় বনজঙ্গলে গাছ কেটে তা নদীপথে নিয়ে যাওয়ার কাজ করতেন বহু মানুষ। তাদের জীবন নিয়ে ফিনল্যান্ডে একটা সময় এরকম অনেক ছবিও তৈরি হয়েছে। সেই জীবনের প্রতিচ্ছবি তারা দেখতে পেয়েছেন তার ‘বাঁশ বৈভবে।’

শাহীন দিল-রিয়াজ এই মূহুর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে নামকরা ডকুমেন্টারি নির্মাতাদের একজন। ‘বাঁশ বৈভব’ তার সর্বশেষ কাজ, যেটির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হলো গত সপ্তাহে হেলসিংকির ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। এ বছরের শেষে এটি জার্মানিতে সিনেমা হলগুলিতে মুক্তি দেয়া হবে। তার প্রস্তুতি চলছে।

বাঁশের ভেলায় জীবনঃ

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট জেলার একেবারে ভারত সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় বিশাল বাঁশ বন। সেই বন থেকে বাঁশ কেটে নদী দিয়ে তা নিয়ে যাওয়া হয় সারাদেশে। যারা এই কাজটি করেন, সেই কাঠুরে আর চালিদের শাহীন দিল-রিয়াজ তার ক্যামেরা দিয়ে অনুসরণ করেন দিনের পর দিন। তার সেই কষ্টসাধ্য কাজের ফসল ‘বাঁশ বৈভব।’

চালিদের সঙ্গে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে। এরপর কুশিয়ারা নদী বেয়ে সুরমায়। তারপর ছোট-বড় আরও কয়েকটি নদী পেরিয়ে মেঘনা। সর্বশেষ গন্তব্য ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর কাছে বৈদ্যের বাজার।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, শাহীন দিল-রিয়াজ যখন এই ডকুমেন্টারি ছবির কাজ করছেন, তখন একই সঙ্গে তার উপরই একটি ডকুমেন্টারি করতে অস্ট্রিয়া থেকে এসেছিল আরেকটি দল। তিনি যখন ‘বাঁশ বৈভবে’র ফিল্মিং নিয়ে ব্যস্ত, অনুসরণ করছেন বাঁশ কাটতে যাওয়া কাঠুরে কিংবা ভেলায় ভাসা চালিদের জীবন, তখন আবার তাকে অনুসরণ করছেন এই অস্ট্রিয়ান দলটি।

ছবিটি করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের। বাঁশের ভেলায় চালিদের সঙ্গে কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। মেঘনা নদীতে ডাকাতের ভয়ে ভেলা থেকে আবার মাঝপথে নেমে পড়তে হয়েছিল।

‘নদীপথে যাত্রাটা ছিল মনোরম। চাঁদনি রাতে বেশ ভালোই লাগতো। কিন্তু জঙ্গলের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। সেখানে প্রচন্ড গরম। জোঁক। মশার অত্যাচার। নানারকম পোকামাকড় সারাক্ষণ আক্রমণ করছে। পাহাড়ী এলাকায় বৃষ্টিতে পথঘাট খুবই পিচ্ছিল। আমরা বারবার পড়ে যাচ্ছিলাম’, বলছিলেন তিনি।

একেবারে সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে যে অসাধারণ গল্প লুকিয়ে আছে, ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার হিসেবে বরাবরই তার প্রতি আগ্রহী শাহীন দিল-রিয়াজ।

বাঁশ বাংলাদেশে গ্রামীন জনগোষ্ঠীর বাড়ি নির্মাণে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি উপাদান। যেভাবে এই বাঁশ সংগ্রহ করা হয় এবং এরপর নদীপথে তা বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, সেটির মধ্য দিয়ে কাঠুরে এবং চালিদের জীবনে গল্প তুলে আনতে চেয়েছেন তিনি এই ছবিতে।

জার্মান অস্কার

তবে শাহীন দিল-রিয়াজের সবচেয়ে প্রশংসিত ছবিগুলোর একটি হচ্ছে ‘লোহাখোর (আয়রন ইটার)।’ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের জাহাজভাঙ্গা শিল্পের শ্রমিকদের ওপর করা ডকুমেন্টারি। ২০১০ সালে এটি জার্মানিতে সেরা টেলিভিশন ডকুমেন্টারি হিসেবে ‘এডলফ গ্রিমে’ পুরস্কার পায়। দ্বিতীয়বার তিনি এই পুরস্কার আবার জেতেন পরবর্তী একটি ছবি ‘প্রোজেকশনিস্টের’ জন্য। এই পুরস্কারকে অনেকে তুলনা করেন জার্মানির অস্কার পুরস্কার বলে।

লোহাখোর ছবি তৈরির আগ্রহ কীভাবে জন্মালো, বলছিলেন তিনি।

‘সীতাকুন্ডের কাছেই আমার ছোটবেলা কেটেছে। ফলে এটার প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল। এটা ছিল একটা ফরবিডেন জোন। আমাদের গ্রাম থেকেই অনেক ছেলে-মেয়ে এই শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাজ করতে যেত। এরপর তারা ফিরে আসতো লাশ হয়ে। কিন্তু ভেতরে কি হচ্ছে, কিভাবে কাজ হচ্ছে কেউ জানতো না। সেটা থেকেই আগ্রহ হয়েছিল জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প নিয়ে ছবি করার।’

গত তিন দশক ধরে জার্মানিতে থাকলেও জন্মস্থান বাংলাদেশের সঙ্গে এখনো তার নিবিড় যোগাযোগ। তার বেশিরভাগ ছবির বিষয় এখনো বাংলাদেশ।

‘ছোটবেলা থেকেই আমার আগ্রহ ছিল সিনেমার প্রতি। তরুণ বয়সে ঢাকায় যুক্ত হই ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে। এরপর জার্মান ভাষা শিখে ফিল্ম নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জন্য জার্মানিতে যাই।’

কিন্তু ডকুমেন্টারি ফিল্ম নিয়ে বাংলাদেশে যেখানে কোন উল্লেখযোগ্য কাজ নেই, সেখানে তিনি কেন এ নিয়ে আগ্রহী হলেন?

‘আসলে ডকুমেন্টারি ফিল্মের প্রতি আমারও আগ্রহ ছিল না। আমি যখন ফিল্ম স্কুলে যাই, আমার ইচ্ছে ছিল ফিকশন তৈরি করার। সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে আমি পড়াশোনা করি। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল আসলে ডিরেকশন নিয়ে পড়াশোনা করার। রুটি রুজির কথা ভেবেই ডকুমেন্টারি বেছে নেই। কিন্তু একবার কাজ শুরু করার পর বুঝতে পারি, ডকুমেন্টারিতেও আসলে গল্প বলার একটি প্রসেস আছে। ডকুমেন্টারি ফর্ম্যাটেই গল্প বলার চ্যালেঞ্জটা আমি নিয়েছি।’

এই মূহুর্তে বাংলাদেশ নিয়ে আরও তিনটি ডকুমেন্টারি ছবি তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত শাহীন দিল-রিয়াজ। এর একটি সুন্দরবন, একটি যমুনার চর এবং আরেকটি ঢাকা শহরের মানুষের জীবন নিয়ে।